বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জাসদের হঠকারিতা, বিএনপির উদযাপন!

  •    
  • ৭ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:৪৭

বিএনপি দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ৭৫-এর ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি। এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না। ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনাপ্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দি হন জিয়া। এমনকি জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেয়ার আবেদন করেছিলেন।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর- এই ৮৫টি দিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত সময়। এই সময়ে যা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসেই তা নজিরবিহীন। হত্যা, নিষ্ঠুরতা, কারাগারে হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু, ষড়যন্ত্র, রাজনীতি, সেনাবাহিনী- সব মিলিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর সময়। ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যার শুরু, তার শেষ হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান সর্বেসর্বা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ৭ নভেম্বর শুরু হয় সামরিক শাসন আর ষড়যন্ত্রের রাচনীতির নতুন অধ্যায়।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আলোচিত, বিতর্কিত, গুরত্বপূর্ণ এবং জট লাগানো দিন। দিনটি একেকজন একেকভাবে পালন করে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই কার বিপ্লব, কে পালন করে; কার হাসি কে হাসে? বিএনপি দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ৭৫-এর ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি।

এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না। ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনাপ্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দি হন জিয়া। এমনকি জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেওয়ার আবেদন করেছিলেন।

খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে বাসার ফোন-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও তার বেডরুমের ফোন লাইনটি সচল ছিল। সেই ফোনেই তিনি কর্নেল তাহেরকে বলেছিলেন, ‘ সেভ মাই লাইফ’। ডাক পেয়ে তাহের তার ‘ সৈনিক সংস্থা’ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। তাহের যে জিয়াকে ভালোবেসে তার জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। বিপ্লবের গোপন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ ভেবেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি।

জাসদের মধ্যেই তখন অনেক বিভ্রান্তি। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের কথা জানতেনই না জাসদের অনেকে। ৭ নভেম্বর বিপ্লব হোক, প্রতিবিপ্লব হোক, ব্যর্থ বিপ্লব হোক, হঠকারিতা হোক– করেছে জাসদ। ৭ নভেম্বর তো বিএনপির সাফল্যের দিন নয়, জাসদের ব্যর্থতার দিন, সেটাই ঘটা করে পালন করে বিএনপি। পদচ্যুত, গৃহবন্দি সেনাপ্রধান ক্যু করতে পারেন, বিপ্লব নয়।

যে সৈনিক জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহেরের অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাঙ্কের ওপর উঠে উল্লাস করেছে, তারা তো জাসদের কর্মী। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি সেদিন জাসদের বিপ্লব সফল হতো; যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বেঈমানি না করতেন, যদি জিয়া তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করে শহীদমিনারে গিয়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিতেন; তাহলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা কেমন হতো? আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকত জাসদ, যেমনটা ছিল ৭৫-এর আগে, বিএনপির হয়তো জন্মই হতো না। সত্যি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে ৭ নভেম্বরের ঘটনায় একটা বিষয় পরিষ্কার- আপনি বিপ্লব করুন আর হঠকারিতা, পাশে জনগণ থাকতে হবে। জাসদ যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদমিনারে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারত, তাহলেই ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। জাসদের সঙ্গে জনগণ আছে, এটা বুঝলে জিয়া অত সহজে ‘পল্টি’ মারতে পারতেন না।

জাসদের বিপ্লব সফল হলে ভালো হতো, আমি এমনটা মনে করি না। জাসদের বিপ্লব সফল হলে কী হতো আসলে তা বলা মুশকিল। যারা বিপ্লবটি করতে চেয়েছিলেন, তারাও এর পরিণতি সম্পর্কে আদৌ জানতেন কি না, আমার সন্দেহ। জাসদ আগে কী অপকর্ম করেছে, পরে কী করতে পারত, সে আলাদা তর্ক। তবে অফিসারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লব ভালো কিছু বয়ে না আনারই কথা। আর সিরাজুল আলম খান যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম খাইয়ে ধ্বংস করেছেন একটি মেধাবী প্রজন্মকে, ৭ নভেম্বর কি তার চূড়ান্ত পরিণতি? জাসদের লোকজন কি তা বিশ্বাস করেন? সিরাজুল আলম খানের কি সায় ছিল ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবে?

মাত্র তিনবছর বয়সি একটা রাজনৈতিক দল কিছু ‘খ্যাপাটে সৈনিকে’র ওপর ভর করে মধ্যরাতে গুলি ফুটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে? বিপ্লব কি এতই সহজ? ৭ নভেম্বর কি জাসদের বিপ্লব, নাকি স্বপ্নবান কর্নেল তাহেরের ইউটোপিয়ান বিপ্লব বিলাস? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাওয়া দায়। জাসদ আসলে এক বিভ্রান্তির নাম। এক জাসদের ছায়াতলে গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। জাসদের এক অংশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে, এক অংশ ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ করতে যায়, এক অংশ ১৫ আগস্ট বেতার ভবনে গিয়ে খুনিদের সঙ্গে তাল মেলায়, এক অংশ সৈনিকদের উসকে দিয়ে সেনা অফিসারদের হত্যা করে। এক অংশের দায় আরেক অংশ নেয় না। ৭২ থেকে ৭৫- এই তিন বছরের বিভ্রান্তি আর হঠকারিতার দায় আজেও বয়ে বেড়াতে হয় বহুধাবিভক্ত জাসদকে।

৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ক্যু করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তিনি আর্মি ক্যু করতে চেয়েছিলেন সিভিলিয়ান স্টাইলে। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার সুযোগে কালক্ষেপণ হয়। বিভ্রান্তি ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, ক্যুর শুরুতেই পলায়ণপর খুনি চক্র কারাগারে হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে।

এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে নামে জাসদ, আরও স্পষ্ট করে বললে কর্নেল তাহের। তিনি জিয়াউর রহমানের মাথায় লবণ রেখে বরই খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের সৈনিকদের উসকানি দিতে যতটা পটু ছিলেন, জনসমাগম করতে ততটা নয়। জনগণ জাসদের পক্ষে ছিল না বলেই তাহেরের চেয়ে বেশি চালাক জিয়া বরইটি নিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেন।

কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অবশ্যই। কারণ তাহের তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ করে ক্যান্টনমেন্টে গোপন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তার বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। এ ধরনের হঠকারী তৎপরতা সবসময়ই অপরাধ। তবে ৭ নভেম্বরই জাসদের প্রথম হঠকারিতা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, এমপি হত্যা, থানা লুট, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ নভেম্বর। আর এই ৭ নভেম্বরেই জাসদের কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঠুকেছিলেন কর্নেল তাহের।

৭ নভেম্বর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় বেদনাদায়ক অধ্যায়টি নিয়েই। ৭ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন শ্রেষ্ঠ বীরকে। খালেদ মোশাররফ তো ছিলেন বীরদের বীর। কর্নেল হুদা আর কর্নেল হায়দারের বীরত্বও মুক্তিযুদ্ধের রূপকথার অংশ। খুনি চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দেয়া খালেদ মোশাররফ আজ যেন ভুলে যাওয়া নাম।

শেখ হাসিনা ইতিহাসের অনেক দায় মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, জেলহত্যা মামলার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। এখন সময় খালেদ-হুদা-হায়দার হত্যার বিচার করার। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে সবাইকেই।

কাগজে-কলমে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির জন্ম হলেও তাদের আদর্শিক জন্ম ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। দিনটিকে তারা পালন করে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস হিসেবে। আর ৭ নভেম্বরের মূল পরিকল্পনাকারী জাসদের কাছে দিনটি ‘সিপাহি বিপ্লব দিবস’। ৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা না থাকলেও তারা দিনটিকে পালন করে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে। রাজনীতিতে ভিন্নতা থাকে, থাকবে। কিন্তু একটি দিন নিয়ে এত বিভ্রান্তি খুঁজে পাওয়া ভার। সকল বিভ্রান্তি তলানিতে ঠেলে ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন সত্যকে তুলে আনবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর