বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কফিনে পতাকা পাননি যে বীর বিক্রম

  • রাহাত মিনহাজ   
  • ৭ নভেম্বর, ২০২১ ১৮:৩৯

স্বাধীন দেশে হুদার প্রথম দায়িত্ব ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে, এরপর ঢাকায় এবং পরবর্তী সময়ে কুমিল্লায়। আর জীবনের শেষ কর্মস্থল হিসেবে রংপুর সেনানিবাসে। সেখানে অবস্থান করার সময়ই তিনি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের খবর পান। হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদার ভাষ্য অনুযায়ী, রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে হুদা খালেদ মোশাররফ ও সেনপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন।

কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ছিলেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ছিলেন ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং আগরতলা মামলার ২৭ নম্বর আসামি। একজন নিবেদিত সেনা কর্মকর্তা। রংপুর সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার। যিনি ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একদল ঘাতক মুক্তিযোদ্ধা- ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল হায়দারের সঙ্গে মিলে বর্বরভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর কর্নেলকে। কিন্তু জাতি আজও জানতে পারল না, কারা এবং কেন তাদের হত্যা করল? আর কেনইবা সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হলো না?

১৯৭৫-এর নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের সামরিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ অধ্যায়। এই ঘটনা প্রবাহের অনেক রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। অনেক সত্য এখনও আটকা পড়ে আছে মিথ্যার মায়াজালে। প্রতি বছর দিনপঞ্জির পাতাতে এই মাসটি এলেই নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়।

সংবাদপত্রের পাতা আর টেলিভিশনের টক শো জমে যায় এসব আলোচনায়। যে আলোচনার পাদপ্রদীপে থাকে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, নৃশংস জেলহত্যা, কর্নেল (অব.) তাহেরের ব্যর্থ বিপ্লব ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসার ঘটনা। যেটি সবচেয়ে কম আলোচিত হয় তা হলো- খালেদ, হায়দার ও হুদার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। খালেদ মোশাররফকে নিয়ে কিছুটা আলোচনা হলেও হায়দার ও হুদার আত্মদানের ইতিহাস থেকে যায় অন্তরালে।

খন্দকার নাজমুল হুদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড লাভ করেন ১৯৬২ সালে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্দীপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা পাঞ্জাবি শোষণ আর বঞ্চনার দিকগুলো প্রত্যক্ষ করেন অনেক কাছ থেকে। যা তাকে দগ্ধ করে। ১৯৬৮-এর ৩ জানুয়ারি ঈদের দিন পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের উগোকি আবাসিক এলাকার সেনা ব্যারাক থেকে গ্রেপ্তার হন হুদা। পরে জানতে পারেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে মামলার এক নম্বর আসামি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এই মামলাতে সামরিক-বেসামরিক ও রাজনীতিবিদ মিলে মোট ৩৫ জন আসামি ছিলেন। ইয়াহিয়া খান এই ৩৫ জনকে দেশদ্রোহী হিসেবে ফাঁসি দিতে চাইলেও ইতিহাসের পথপরিক্রমায় তারা সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কাছে জাতীয় বীর হিসেবে বিবেচিত হন। তাদের মুক্ত করতে সংগঠিত হয় অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থান। যে অভ্যুত্থানের জোয়ারে পতন হয় লৌহমানব ইয়াহিয়া খানের শাসন দুর্গের। শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্ত মুক্ত হন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে বরখাস্ত হন খন্দকার নাজমুল হুদা।

নাজমুল হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদার ভাষ্য অনুযায়ী-

“এর পরের দিনগুলো হুদার জন্য ছিল অনেক কঠিন। সেনাবাহিনীর চাকরি নেই, আয় বন্ধ। পরিবারে অর্থ সংকট। সবকিছু মিলিয়ে অনেকটা বিপর্যস্ত ছিলেন হুদা। ওই সময় সংসার চালাতে খুব ছোট ব্যবসা করেছেন। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সংসার চালিয়েছেন।” তবে একজন জাতীয়তাবাদী হুদার জীবনে ১৯৭১ আসে এক ভিন্ন বার্তা নিয়ে। হুদা যেন দীর্ঘদিন ধরে এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি জানতেন পাঞ্জাবি অপশাসন বেশিদিন বাঙালি জাতি মানবে না। আর পাকিস্তানিরাও বাঙালির হাতে কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা দেবে না। অতএব যুদ্ধ অনিবার্য।

১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় হুদা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। তার সঙ্গে খালেদ মোশাররফের অনেক নিবিড় যোগাযোগ ছিল। খালেদ মোশাররফ তখন মেজর হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। মধ্য মার্চে খালেদই হুদাকে ঢাকা ছাড়তে বলেছিলেন। কারণ তিনি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ভয়াবহ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আর এমন কিছু ঘটলে হুদা হবেন অন্যতম লক্ষ্য।

খালেদ মোশাররফ ঠিকই অনুমান করেছিলেন। কারণ ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের শুরুতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। অপারেশান সার্চলাইটের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা বর্বরভাবে হত্যা করে আগরতলা মামলার দুই নম্বর আসামি নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে।” (স্মৃতি- ১৯৭১: ২০১৮)।

অপর আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুলনা থেকে নিখোঁজ হন। পরে আর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার নিখোঁজ হওয়া আজও এক বড় রহস্য।

উত্তাল অসহযোগের মধ্য মার্চে খালেদের উপদেশ অনুযায়ী হুদা কুষ্টিয়াতে চলে যান। ওই সময় কুষ্টিয়াও উত্তাল। প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলছিল, চারদিকে সর্বাত্মক অসহযোগ। ২৫ মার্চের কালরাতে হুদা কুষ্টিয়া থেকেই পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর পান। ওই সময় কুষ্টিয়া শহরের চারপাশেও পাকিস্তানিরা ছিল। সেখান থেকে বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে কদিনের মধ্যেই কলকাতা পৌঁছে যান। সেখানে সরাসরি যুক্ত হন মুক্তি সংগ্রামে। বাংলাদেশের যুদ্ধাঞ্চলকে ১১ ভাগে ভাগ করার পর হুদাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ৮ নম্বর সেক্টরে।

এই সেক্টরের বয়রা অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি। এই সাব-সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর বেশ কটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে হুদার সাব-সেক্টরের অধীন যশোর শত্রুমুক্ত হয় ৭১-এর ৬ ডিসেম্বর। যশোর সার্কিট হাউজে হুদাই উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।

স্বাধীন দেশে হুদার প্রথম দায়িত্ব ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে, এরপর ঢাকায় এবং পরবর্তী সময়ে কুমিল্লায়। আর জীবনের শেষ কর্মস্থল হিসেবে রংপুর সেনানিবাসে। সেখানে অবস্থান করার সময়ই তিনি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের খবর পান। হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদার ভাষ্য অনুযায়ী, রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে হুদা খালেদ মোশাররফ ও সেনপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহকে ৩২ নম্বরের দিকে ট্রুপস মুভ করাতে বলেছিলেন। (হুদা: ২০১৫: পৃষ্ঠা ১০৭)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরই দেশ চলতে শুরু করে উলটো রথে। ক্ষমতার কেন্দ্র তখন বঙ্গভবন। সেনানিবাসে না ফিরে মোশতাককে সামনে রেখে দেশ চালাচ্ছিল ফারুক-রশীদ খুনিচক্র। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া জেনারেল জিয়াও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন না। ফলে খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিলসহ কজন সেনা কর্মকর্তা নতুন করে কিছু একটা করার পরিকল্পনা শুরু করেন। তাদের যুক্তি ছিল, এভাবে দেশ চলতে পারে না।

এই পরিকল্পনার মধ্যেই ৩০ অক্টোবর রংপুর থেকে ঢাকায় একটা সেনা কনফারেন্সে যোগ দেন হুদা। এদিকে চূড়ান্ত হয়ে যায় নতুন পরিকল্পনা। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয় ৩ নভেম্বর রাতে। ওই রাতে বঙ্গভবনে খুনিদের পাহারায় নিয়োজিত সেনারা সেনানিবাসে ফিরে আসে। সকালে বঙ্গভবনের উপরে চক্কর দেয় মিগ যুদ্ধবিমান। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া গৃহবন্দি হন। সিজিএস খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হিসেবে কমান্ড গ্রহণ করেন। যে ঘোষণা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ৫ নভেম্বর (জামিল: ২০০৯)

নীলুফার হুদার ভাষ্য অনুযায়ী-

“৩ নভেম্বর ১৯৭৫ কর্নেল হুদা টেলিফোনে ঢাকার সাথে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখছিলেন। এই যোগাযোগের মধ্যে তিনি টেলিফোনে অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে বারবার বলেছেন, জেনারেল জিয়াকে যাতে সম্মানে রাখা হয়।” (হুদা: ২০১৫: পৃষ্ঠা: ১১৩)

৪ নভেম্বর রংপুর থেকে ঢাকায় যান কর্নেল হুদা। সঙ্গে ছিলেন জাফর ইমাম নামের এক সেনা কর্মকর্তা। জাফর ইমাম ৫ তারিখে রংপুর ফিরে আসেন। কিন্তু হুদা আর ফিরতে পারেননি। ৪ থেকে ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫- এ সময়ে খালেদ-শাফায়াত ও হুদা-হায়দাররা পরিস্থিতিকে তাদের অনুকূলে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু মাঝখানে ঘটে যাওয়া জেলহত্যা, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য হওয়া শোক মিছিল (যাতে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই অংশ নিয়েছিলেন), ভারতীয় হস্তক্ষেপের গুজব এবং জাসদের তৎপরতায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

ধীরে ধীরে অভ্যুত্থানের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকেন খালেদ মোশাররফ। এছাড়া সেনাবাহিনীতে ফারুক-রশীদের অনুগত ইউনিট ও জিয়ার অনুসারীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। শেষে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বিপ্লবী সেনা সংস্থার মাধ্যমে সংঘটিত হয় এক পাল্টা অভ্যুত্থান। যার নেতৃত্বে ছিল সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের। এই পাল্টা অভ্যুত্থানে পুরো পরিস্থিতি খালেদ মোশাররফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

এসব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের জবানিতে। তিনি তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইয়ে তাদের অভ্যুত্থান নস্যাৎ হওয়ার প্রেক্ষাপটে লিখেছেন-

“রাত দশটার দিকে খালেদ মোশাররফের ফোন পেলাম। ফোনে তিনি আমাকে বঙ্গভবনে যেতে বললেন। বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছি, তখন ব্রিগেডিয়ার মেজর হাফিজ আমাকে বললো, স্যার প্রথম বেঙ্গলের একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ঐদিন রাত বারোটায় সিপাহীরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ ও সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটা করবে। খালেদ ও আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশও সৈনিকদের দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেসিওটি।” (জামিল: ২০০৯: পৃষ্ঠা: ১৪৩)

এরপরের ঘটনা সবার জানা। রাত ১২ টায় শুরু হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বিপ্লব। ৩ নভেম্বর খালেদের অভ্যুত্থান অস্বাভাবিক রকমের রক্তপাতহীন থাকলেও এই পাল্টা অভ্যুত্থান আর রক্তপাতহীন থাকেনি। সিপাহীদের বিপ্লব শুরু হওয়ার পর বঙ্গভবন থেকে হুদা ও হায়দারকে নিয়ে বের হয়ে যান খালেদ। বঙ্গভবনে থেকে যান শাফায়াত জামিল। বিদ্রোহীরা বঙ্গভনের দিকে এগিয়ে এলে বঙ্গভবন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন শাফায়াতও। এদিকে খালেদ-হুদা ও হায়দার আশ্রয় নেন দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টে। যে রেজিমেন্টকে খালেদই রংপুর থেকে ঢাকায় এনেছিলেন। খালেদের আশা ছিল কোনো বিপদে এই রেজিমেন্ট তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। বিশ্বস্ত দশম বেঙ্গলেই কয়েকজন সেনা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে খালেদ-হুদা ও হায়দারকে। (জামিল: ২০০৯: পৃষ্ঠা: ১৪৫)

ঢাকা তখন উত্তাল, চারদিকে চাপা উত্তেজনা, উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন বেশ কজন সেনা কর্মকর্তা। সন্ধ্যার পরই ঢাকা সেনানিবাস ও পুরো শহরে অজানা আতঙ্ক। এমন এক পরিবেশেই স্বামীর মরদেহ গ্রহণ করেন নিলুফার হুদা। হুদাকে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে। তার মরদেহ গ্রহণ থেকে শুরু করে ওই সময় জেনারেল জিয়াসহ বেশ কজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন নীলুফার হুদা। তিনি হুদার মরদেহ একটা জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু সে অনুরোধ রাখা হয়নি। একজন বীর বিক্রমের কফিনে দেয়া হয়নি একখণ্ড লাল-সবুজ কাপড়। হুদার মতোই খালেদ মোশাররফ ও হায়দারের দাফন সম্পন্ন হয় অনেকটা নিভৃতে, অজানা আতঙ্কের মধ্যে।

খালেদ-হুদা ও হায়দারকে কে বা কারা হত্যা করল? হুদার স্ত্রী নীলুফার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বহু বছর ধরে। তবে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত থাকা অনেক সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নীলুফার হুদা এই তিন বীর যোদ্ধা হত্যার জন্য কর্নেল (অব.) তাহের ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রতি ইঙ্গিত করেন। এ সময়ের লে. কর্নেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরীর এক বর্ণনা অনুযায়ী-

“৭ নভেম্বর সকালে দ্বিতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্টে জেনারেল জিয়ার সাথে কর্নেল তাহেরও ছিলেন। সেই সময়ই দশম বেঙ্গল থেকে ফোনে জানানো হয় খালেদ-হুদা-হায়দারের অবস্থান। যে আলোচনা তাহের শুনেছিলেন এবং তিনি তখন ঐ ঘর থেকে বের হয়ে যান। ১৫ মিনিট পর তাহের আবার ঐ ঘরে ফিরেছিলেন। এরই মধ্যেই এক প্লাটুন সেনা দশম বেঙ্গলে গিয়ে খালেদ-হুদা-হায়দারকে হত্যা করে। আধা ঘণ্টা পর জেনারেল জিয়ার কাছে খবর আসে খালেদ-হুদা-হায়দারকে হত্যা করা হয়েছে।” (হুদা: ২০১৫)

খালেদ, হুদা ও হায়দারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ এই তিন বীর যোদ্ধার হত্যার জন্য জেনারেল জিয়াকে দায়ী করে। এই পরস্পরবিরোধী, পাল্টাপাল্টি দাবি-দোষারোপের রাজনীতি আজও শেষ হয়নি। চলছে তো চলছেই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার প্রকৃত তথ্য জানার অধিকার রাখে।

সহায়ক গ্রন্থ:

১. হুদা, নীলুফার (২০১৫)। কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ, ঢাকা: প্রথমা।

২. স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, (২০১৮)। সম্পাদনা: রশীদ হায়দার ঢাকা: বাংলা একাডেমি।

৩. জামিল, কর্নেল (অব.) শাফায়াত (২০০৯) একাত্তর মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়।

এ বিভাগের আরো খবর