বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা শিবির কি নিরাপদ?

  • শেখ আবদুর রহমান   
  • ৭ নভেম্বর, ২০২১ ১৬:৪৩

পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কোনো একটি অঘটন ঘটিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে লুকিয়ে থাকার সুবিধা, রোহিঙ্গা শিবিরকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। সাম্প্রতি এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

কৌশলগত দিক থেকে যদি বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হলো মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থল? সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা শিবিরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে রোহিঙ্গাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মহিব উল্লাহসহ আরও ৭ জনকে হত্যার ঘটনা ঘটে। আর তাতেই প্রশ্ন আসে- সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা শিবিরগুলো নিরাপত্তা হুমকির দিক থেকে ভেতর কিংবা বাইরে কতটা নিরাপদ? দ্রুততার সঙ্গে কী পদক্ষেপ সেখানে নেয়া যায়?

বাংলাদেশ-মিয়ানমারে সীমান্তের দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরসহ পুরো এলাকাটি যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক পর্যায়েও আছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। এলাকাটি অপরাধ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাদক ইয়াবার কথা। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৯২ শতাংশ রোহিঙ্গা এবং যার ৯৬ ভাগ ইয়াবা বাংলাদেশে ঢোকে মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা টেকনাফ দিয়ে। মাদক পাচারের পাশাপাশি মানব পাচার, অস্ত্রযুদ্ধ, চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদ মিলিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তবর্তী হওয়ায় ক্যাম্পগুলোকে আন্তসীমান্ত যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারেরও ঝুঁকি রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধে সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন অন্তত ১৪টি দল সক্রিয় রয়েছে। যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য ওয়াকিটকি এবং মিয়ানমার পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি) সিম কার্ড ব্যবহার করছে তারা।

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে নিহতের সংখ্যা ২৩৪ জন। এসব ঘটনায় ২ হাজার ৯৪৫ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ১ হাজার ৩০১টি মামলা হয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক দমন-পীড়নের পর এবং কক্সবাজার ক্যাম্পে অবস্থানরত অপরাধীদের চাপে পড়ে হত্যা, ধর্ষণ, চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের মুখোমুখি হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। নিজ জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।

এ ছাড়া, ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ঘনত্বও উদ্বেগের কারণ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ৯ লাখ রোহিঙ্গা ১৩ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে বসবাস করছেন। যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা থাকেন।

ক্যাম্পের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়েছে তিন ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ (এপিবিএন)। এদের মোতায়েন করা হলেও তাদের পক্ষে অগোছালো ক্যাম্প ও সীমান্তবর্তী এলাকায় এমন ঘনবসতি থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ কঠিন।

উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ হলো, পর্যটনভূমি হিসেবে খ্যাত দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবির থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সমুদ্রসৈকতগুলোর মধ্যে বেশ আকর্ষণীয় ইনানী থেকে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের দূরত্ব মাত্র সাড়ে সাত মাইল (৭ দশমিক ৫৭ কি.মি.) এবং কুতুপালং থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ১ দশমিক ৮৬ মাইল।

পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কোনো একটি অঘটন ঘটিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে লুকিয়ে থাকার সুবিধা, রোহিঙ্গা শিবিরকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে। সাম্প্রতি এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

সামাজিক সংহতি ছাড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবাধে চলাফেরা করতে দিতে পারে না বাংলাদেশ। সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

প্রথমত, সীমান্তপ্রাচীর ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে হবে। ক্যাম্প ও সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর প্রভাব এখনও শিবিরে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা কমাতে মাঝিদের (রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা) নেতৃত্বের ভূমিকা বাড়াতে হবে।

তৃতীয়ত, ভাসানচরে আরও ৮১ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু না হওয়া পর্যন্ত ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া স্থানান্তর প্রক্রিয়ার আলোকে আরও রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সম্ভাব্যতা খুঁজে বের করতে প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন দরকার।

চতুর্থত, মিয়ানমারের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে, অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নিরাপদ স্বর্গ’ তৈরির বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভাবতে হবে। সবার অনুধাবন করা উচিত যে, ক্যাম্প এবং সীমান্তের নিরাপত্তাহীনতা গোটা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তাহীনতা।

পরিশেষে, সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা শিবিরগুলো প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ঘাঁটি হয়ে ওঠার পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি তৈরি করছে। বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাস্তব চিত্রটি সামনে এনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।

লেখক: গবেষক, সেন্ট্রাল ফাউন্ডেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ (সিএফআইএসএস)। নিরাপত্তা ইস্যু, অর্থনৈতিক-কূটনীতি ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছেন ।

এ বিভাগের আরো খবর