জাহিদুর রহমান, এনটিভির বিশেষ সংবাদদাতা। তার কাজের ক্ষেত্র সাভার। কিন্তু সাভারের ছোট গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেন না। জাতীয়-আন্তর্জাতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও সরব এই গণমাধ্যমকর্মী। দুই দফা এনটিভিতে কাজ করার সুবাদে তাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। এখনও সাভারে বেড়াতে গেলে তার সঙ্গ পাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় এই গণমাধ্যমকর্মী।
সকালে তার একটি পোস্ট দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বৃহস্পতিবার থেকে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বসে ভাড়া সমন্বয়ের ঘোষণা না আসা পর্যন্তু সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে, পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের ব্ল্যাকমেইলিং। অনেকে এটাকে ধর্মঘট বলছেন বটে, তবে এটা কোনোভাবেই ধর্মঘট নয়, পরিবহন-সংশ্লিষ্টরাও ধর্মঘট বলছেন না।
এটা আসলে স্রেফ ব্ল্যাকমেইল করে দাবি আদায়ের চেষ্টা। সব সভ্য দেশেই কিছু আইন-কানুন আছে। আমরা যেহেতু নিজেদের সভ্য দাবি করি, তাই আমাদেরও কিছু আইন-কানুন আছে। কিন্তু দাবি করলেও আমরা আসলে সভ্য নই, কারণ আমরা আইন-কানুন মানি না। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নানা সংগঠন আছে, সেগুলো নিবন্ধিতও। বিভিন্ন দাবি আদায়ে এসব সংগঠনের ধর্মঘট ডাকারও অধিকার আছে। তবে ধর্মঘট ডাকারও কিছু নিয়ম আছে।
দাবি আদায়ের জন্য যৌক্তিক সময়ের আলটিমেটাম দিয়ে তবেই ধর্মঘটে যাওয়া যায়। কিন্তু এমন বিনা নোটিশে ধর্মঘট ডাকা যায় না। ডাকলে তাদের নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই তারা ধর্মঘট ডাকে না। ফোনে ফোনে কথা বলে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখে। নিয়ম মেনে, সময় দিয়ে ধর্মঘট ডাকলে মানুষের দুর্ভোগ কম হয়। হঠাৎ গাড়ি চালানো বন্ধ রাখলে মানুষের কষ্ট বেশি হয়। আর এই কষ্ট বেশির দোহাই দিয়ে দাবিও দ্রুত আদায় করা যায়। এই ব্ল্যাকমেইল কৌশলের আবিষ্কারক সাবেক এক মন্ত্রী। তিনি যখন মন্ত্রী, তখন তার বাসা থেকে সারা দেশে ফোন করে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমার ধারণা পরিবহন মালিকদের এই ব্ল্যাকমেইল কৌশলে সরকারের সায় আছে। শিগগিরই পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলবেন, জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করেই তাদের দাবি মানতে হলো। অথচ যারা বিনা ঘোষণায় গাড়ি চালানো বন্ধ রাখল, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশটা আসলে মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। এখানে সাধারণ মানুষকে যে যত বেশি কষ্ট দিতে পারে, সেই তত ক্ষমতাশালী। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস মালিকরা অবশ্য এত কৌশলী নন, তেলের দাম বেড়েছে ২৩ ভাগ, তারা ভাড়া বাড়িয়েছেন ৩৯ ভাগ। তাদের দয়ার শরীর, মাত্র ৩৯ ভাগ বাড়িয়েছেন। ৫০ ভাগ বাড়ালেও তো কারো কিছু বলার বা করার ছিল না। মুল্লুকটা তো আসলে মগের।
বলছিলাম জাহিদুর রহমানের কথা। সকালে ফেসবুকে তিনি তুলে ধরেন হঠাৎ যান চলাচল বন্ধে মানুষের দুর্ভোগের কথা, ‘সকাল থেকেই গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সংবাদের পেছনে ছুটছি আর কাছ থেকে দেখছি সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে আর টেনশনে অনেকে ঘামছেন। অস্থির হয়ে একে অন্যকে ফোন করছেন। আহারে! এসব দেখে খুব মায়া লাগছিল। একপর্যায়ে হাতে থাকা কলেজে ভর্তি আর সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে নিয়েই গর্জে উঠলেন তারা।
এতদিন ধরে পরীক্ষার হলে যাওয়ার কতশত প্রস্তুতি! অথচ ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়েই মুহূর্তের অনিশ্চয়তায় সব ভুলে স্লোগান হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সেসব প্রস্তুতি ঝরে পড়ল নিশ্চল সড়কে। একদিকে নির্লিপ্ততা! অন্যদিকে স্লোগানে বিক্ষোভ। এই বৈপরীত্যের মাঝে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাওয়া তারুণ্যের ছোটবড় স্বপ্নগুলোকে দেখছিলাম তছনছ হয়ে যেতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও ১৯টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল আজকের দিনটিতে।
পথে নেমেই আকস্মিক ধর্মঘট। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে এই ধর্মঘট ডেকেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।
নিমিষেই স্বপ্ন পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে। একপর্যায়ে প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে নিজেরাই সড়কে নেমে বিক্ষোভ করলেন। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে ঘুরছে তো ঘুরছেই।
আচ্ছা এই মানুষগুলোর দোষ কী? হায়রে নিয়তি! কে দেবে তাদের সান্ত্বনা?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা জানি না। সরকার কোনোদিন জানবেও না পরিবহন মালিকদের হঠাৎ ব্ল্যাকমেইলে কত তরুণের শিক্ষাজীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে যাবে। কত যুবকের চাকরির স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। এই পরীক্ষাগুলোর তারিখ বদলাবে না। যারা তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিল, তাদের শাস্তি তো হবেই না, উল্টো দ্রুত তাদের দাবি মেনে নেয়া হবে।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসাতে মানুষের চলাচল বেড়েছে, জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দামও বেড়েছে। সেই দামের সঙ্গে সমন্বয়ের অজুহাতে বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাও কী লিটারে ৬৫ টাকা থেকে এক লাফে ৮০ টাকা করেছে, মানে বাড়িয়েছে ২৩ ভাগ।
সরকার হয়তো ভেবেছে বার বার বাড়ালে বার বার সমালোচনা হবে, তারচেয়ে একবারে বাড়িয়ে দেয়াই ভালো। আর শুধু ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়িয়েই সরকারের খিদে মেটেনি, একই দিনে বেড়েছে এলপিজি ও ফার্নেস অয়েলের দামও। বৃহস্পতিবার ছিল বাংলাদেশে দাম বাড়ার দিন। যেসব পণ্যের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষই সরকারের মূল প্রতিপক্ষ। তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। তেল একটি সাংঘাতিক কৌশলগত পণ্য।
কারণ জ্বালানি তেলের দাম মানে শুধু জ্বালানি তেলের দাম নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক কিছু। প্রথমদিনের দুর্ভোগের কথা তো আগেই বললাম। মূলত, বাস-ট্রাক চলে ডিজেলে। তাই বাস ভাড়া বাড়বে; পণ্য পরিবহনব্যয় বাড়বে, তাতে বাড়বে পণ্যমূল্য। ডিজেল সেচের পাম্পে ব্যবহার করা হয়। তার মাসে সেচের খরচ বাড়বে, বাড়বে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যয়। একসঙ্গে উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন ব্যয় বাড়লে বাজারে তার কী প্রভাব পড়বে সেটা জানতে কি আমাদের সিপিডির গবেষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?
ডিজেল-ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর কেরোসিনের দাম বাড়লে কত মানুষের ঘরে আলো জ্বলবে না, ঢাকার এসি রুমে বসে তার হিসাব জানা সম্ভব নয়। আসলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো এক চক্রবৃদ্ধি দুর্ভোগের সূচনা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে বলেই দেশে দাম বাড়াতে হচ্ছে, এটাই সরকারে যুক্তি। নইলে তাদের লোকসান হবে। অক্টোবরে সরকারের লোকসান হয়েছে ৭২৩ কোটি টাকা। কিন্তু সরকার তো ব্যবসায়ী নয়, তারা তো অত লাভ-লোকসানের হিসাব কষবে না। তারা তো জনগণের পাশে থাকবে। বাংলাদেশে যেদিন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, সেদিনই ভারতে দাম কমানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব তো ভারতেও পড়বে। তাহলে তারা না বাড়িয়ে উল্টো কমালো কীভাবে? রবি মৌসুমকে সামনে রেখে তারা কৃষককে স্বস্তি দিতে চেয়েছে, বাজার স্বাভাবিক রাখতে চেয়েছে। এই ভাবনাগুলো কি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায় নেই?
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে সমন্বয়ের জন্য সরকার উতলা হয়ে যায়। কিন্তু দাম কমলে তারা টিনের চশমা চোখে দিয়ে ঘুমায়। মাঝে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কম ছিল। সাত বছরে সরকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। আর এখন একমাসে ৭২৩ কোটি টাকা লোকসান পোষাতে ২৩ ভাগ মূল্যবৃদ্ধি অগ্রহণযোগ্য। জনগণের কথা ভাবলে সরকার এটা করতে পারত না। চারদিকে কত দুর্নীতি, কত অপচয়, কত লুটপাট, কত পাচার; সেদিকে নজর দিলে, একটু সুশাসন আনলে, সরকারকে আর তেলের দাম বাড়াতে হতো না।
করোনা এমনিতে সাধারণ মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। দেড়বছর অর্থনীতি স্থবির ছিল। সরকার যেদিন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, সেদিনই বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডির এক জরিপে বলা হয়, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ। আরেক জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। মানুষ যখন বেকার হয়েছে, তাদের আয় কমেছে; তখন সরকারের উচিত ছিল; সাধারণ মানুষের পাশে থাকা। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। করোনায় সরকার অনেক প্রণোদনা দিলেও তার সুফল সাধারণ মানুষ পায়নি।
আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস, তখন নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। সবকিছুর দামই বাড়তি। মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরেন। সেখানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকারের উচিত আগে বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা। তারপর লাভ-লোকসান বিবেচনা করা। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার আসলে নিত্যপণ্যের বাজারের আগুনে ঘি ঢালল।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।