বিশ্বের মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি গৃহীত হয়, তার ১৬.৯ নম্বরের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জন্মনিবন্ধনসহ সকলের জন্য বৈধ পরিচয়পত্র প্রদান।
বস্তুত প্রতিটি জন্মই মূল্যবান। তাই প্রতিটি জন্মই নথিভুক্ত হওয়া উচিত। নাম ও জাতীয়তা প্রতিটি শিশুর অধিকার। জন্মনিবন্ধন সরকারের জাতীয় নীতিমালা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জন্মনিবন্ধন শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমকেও শক্তিশালী করতে পারে। জন্ম নথির বদৌলতে বাল্যবিবাহ, পাচার ও শিশু শ্রম থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব। জন্মসনদের পরিধি ও ব্যবহার আরও বাড়ালে যুদ্ধের মতো সহিংস পরিস্থিতিতে বা অভিবাসনের সময় শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হয়।
যদিও জন্মনিবন্ধন সেবা গ্রহণের সুযোগ ও তার গ্রহীতার সংখ্যার মধ্যে এখনও বিস্তর ব্যবধান। অভিভাবকের উদাসীনতার করণে শিশু জন্মনিবন্ধনের বাইরে থেকে গেলে আইনি সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত করে। জন্মনিবন্ধন না থাকলে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে থেকে শিশুদের রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিশু অপরাধীও জন্মসনদ ছাড়া শিশু হিসেবে আইনি সুবিধা পায় না।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মাত্র ৩৭ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী এক কোটি শিশু সরকারি হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। সরকারি নিয়মে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নবজাতকের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হয়।
অথচ বেশিরভাগ মা-বাবাই এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। তারা ছেলে-মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার সময়, সাধারণত শিশুর বয়স যখন ছয় বছর, তখন জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। কীভাবে শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হয়, সে বিষয়েও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। অনেক সময় প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সরকারি দপ্তর পর্যন্ত এসে সনদ নেয়ার যাতায়াত খরচই অনেক বাবা-মায়ের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এরকম বাস্তবতায় গত ২৬ অক্টোবর ‘নিউজবাংলা’র একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘ইউনিক আইডি করতে জন্ম নিবন্ধনের জটিলতা কেন’। খবরে বলা হয়, প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি করা হচ্ছে স্কুলগুলোয়। এটি করতে গিয়ে অনেক অভিভাবকই ভোগান্তিতে পড়ছেন। মূল সমস্যাটি দেখা দিচ্ছে শিশুর অনলাইন জন্মনিবন্ধন নিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে মা-বাবারও জন্মনিবন্ধনের প্রয়োজন পড়ছে!
প্রশ্ন হলো, কেন এই ইউনিক আইডি? প্রকল্পের পরিচালক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এক জায়গায় রাখার জন্য ইউনিক আইডি তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে কোনো শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করা হচ্ছে।
আর ১৮ বছরের বেশি বয়সিদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে। এই দুই স্তরে আইডেন্টিফিকেশন নম্বর আছে। কিন্তু মাঝখানে বাদ পড়ে যাচ্ছে প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এদের আইডেন্টিফিকেশনের আওতায় আনার জন্যই ইউনিক আইডি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থী সব ধরনের সেবা ইউনিক আইডির মাধ্যমে পাবে। যেমন বই নেয়া থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন, বৃত্তি, উপবৃত্তির অর্থ নেয়া ইত্যাদি। যখন শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তখন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে এই ইউনিক আইডিই জাতীয় পরিচয়পত্রে রূপান্তর করবে।
শুধু তাই নয়, ইউনিক আইডির মাধ্যমে কে কোথায় কোন লেভেলে লেখাপড়া করছে, ঝরে পড়ল কি না, চাকরি পেল কি না ইত্যাদিও জানা যাবে। ইউনিক আইডির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। ফলে সরকারের বিভিন্ন সেবা যেমন- বিনামূল্যের বইও সঠিক সংখ্যায় ছাপানো যাবে।
তার মানে উদ্যোগটা মহৎ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা ভিন্ন। জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে একসময় নাগরিকদের নানারকম হয়রানির শিকার হতে হতো। তবে এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন করায় সেই হয়রানি অনেক কমেছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারেও এই সেবা চালু থাকায় প্রান্তিক মানুষ সহজেই নিবন্ধন করতে পারছেন। যদিও সিটি করপোরেশন এলাকায় শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে এখনও অনেকে ভোগান্তির শিকার হন বলে শোনা যায়।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ভোগান্তি অন্য জায়গায়। যেমন মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ এবং পরিচয়পত্র ছাপানোর প্রক্রিয়ায় অসংখ্য মানুষের নামের বানান, জন্মতারিখসহ অন্যান্য তথ্য ভুল হয়েছে। একবার কারো হাতে এই ভুল পরিচয়পত্র চলে আসার পরে সেটি সংশোধন করতে গিয়ে তাকে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন।
অভিযোগ আছে, পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের অফিস এমনকি কেন্দ্রীয় অফিসেও একটা বিরাট চক্র গড়ে উঠেছে—যারা এই কাজ করে দেয়ার নামে নাগরিকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া এখন রাষ্ট্রীয় কোনো সেবাই পাওয়া যায় না, তাই নাগরিকরা টাকা-পয়সা দিয়ে হলেও ভুল সংশোধনে বাধ্য হয়। অথচ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এই ভুলের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়ী নন। হয়তো ভুল হয়েছে যিনি মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তার কারণে। অথবা প্রেসে। অথচ তার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগে খোঁজ নিলে জানা যাবে ভুল সংশোধনের জন্য প্রতিদিন কী পরিমাণ আবেদন জমা পড়ছে এবং নাগরিকরা কত ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই জটিলতা ও হয়রানির এড়ানোর জন্য ই-ফাইলিং সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এতে কোনো আবেদন ফেলে রাখার সুযোগ থাকবে না। এ ব্যবস্থায় ট্র্যাকিং নম্বরের মাধ্যমে জানা যাবে একটি ফাইল কোথায় কোন কর্মকর্তার কাছে আছে। কোনো আবেদন পাওয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে উপজেলা বা থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে আবেদনটি অনলাইন সিস্টেমে আপলোড করতে হবে।
কোনো তদন্ত বা তথ্য প্রয়োজন হলে এনআইডি অনুবিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানানো হবে। নাগরিকরা যাতে সেবা পাওয়ার জন্য অযথা ঘোরাঘুরি না করেন, সেজন্য একজন কর্মকর্তাকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব দিতে হবে।
মুশকিল হলো, নাগরিকের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি সরকারি অফিসেই ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হলেও যারা এই সিস্টেমে নাগরিকদের সেবা দেবেন, তাদের দক্ষতার চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় মানসিকতা। নাগরিকরা সহজেই, বিনা হয়রানিতে সব সেবা পেয়ে গেলে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপরি আয় বা ঘুষবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং তারা নিজেদের স্বার্থেই সিস্টেমগুলো অকেজো করে দেয়া বা অচল করে দেয়ার ফন্দি-ফিকির করে— এ অভিযোগও নতুন নয়।
সেবা পেতে গিয়ে সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে ‘মেশিন ঠিকমতো কাজ করছে না; নেটওয়ার্ক দুর্বল; দুদিন পরে আসেন; ফাইল তো স্যারের টেবিলে’—এরকম মুখস্থ বুলি শুনে নাগরিকরা অভ্যস্ত। সুতরাং, জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি পেতেও অভিভাবকরা এরকম কোনো হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার যাতে না হন— সে বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।