বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কি কঠিন?

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ৩০ অক্টোবর, ২০২১ ১৬:৫৪

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীকেন্দ্রিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার জাতিসংঘ সম্মেলনে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে এ নিয়ে কথা বলেছেন। গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলনে তিনি রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় নিয়ে কথা বলেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। এর এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২২ অক্টোবর খুন হন আরও ৭ জন। এ দুটি ঘটনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো যে ধীরে ধীরে অপরাধীদের আখড়া হয়ে উঠছে তারই প্রমাণ দেয়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই দুই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই যে এ ধরনের ঘটনার সমাপ্তি হলো বিষয়টি কিন্তু সেরকমও নয়। বরং এ ক্যাম্পগুলোতে প্রতিনিয়তই খুনের পাশাপাশি গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, চোরাচালান, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নৈরাজ্যে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায়ে ভোগে। নারী ও শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। পরিবারের সদস্যদের সামনে থেকেই নারীদের তুলে নেয়ার অভিযোগও আসে গণমাধ্যমে। এসব অপরাধে জড়িতদের বিচার না হলে অপরাধীরা ভুল বার্তা পাবে ও তাতে অপরাধ আরও বাড়বে।

রোহিঙ্গাদের মাঝেও তাদের ঘিরে সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ চক্র। রোহিঙ্গাদের অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় অপরাধীরাও তাদেরকে নিজদলে ও গ্রুপে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। এসব স্থানীয় অপরাধী চক্র মাদক ব্যবসা, চোরাচালান ও মানবপাচারসহ নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এসব স্থানীয় অপরাধী চক্রের মধ্যে ডাকাতদলও রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের দল ভারী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যেও রয়েছে একাধিক গ্রুপ। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়েও রয়েছে বিরোধ। বিরোধ রয়েছে অবৈধ ব্যবসা ও লেনদেন নিয়ে। বিদেশি সাহায্যের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েও সক্রিয় রয়েছে নানা গ্রুপ। সব মিলিয়ে নানা ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল এখন চরমে।

তাদের এসব অন্তর্কোন্দলের জের ধরে হামলা-মামলা একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত চার বছরে নানা ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৩২ জন। তাদের অপরাধের খতিয়ান আরও দীর্ঘ। এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খুনের মামলাই হয়েছে ৭১টি। এছাড়া মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র, ধর্ষণ, অপহরণ ও ডাকাতির মামলাতো রয়েছেই। এসব অপরাধে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৯৮টি। দিন যত যাচ্ছে অপরাধ ও মামলার সংখ্যাও তত বাড়ছে।

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড বা ৭ খুনের ঘটনা রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংকটেরই বহিঃপ্রকাশমাত্র। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অনেকেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও তাদের অনুসারীদের দায়ী করছে। মুহিবুল্লাহ নানাভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছিলেন। তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মুহিবুল্লাহ জোরালো ভূমিকা পালন করছিলেন।

এমনকি তিনি মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনেরও দাবি জানান। সেকারণেই মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে মিয়ানমারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সন্দেহের বাইরে নয়। এছাড়া মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে এটি অনেকেরই ধারণা। শুধু মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডই নয়, রোহিঙ্গাদের ঘিরে নানা অপরাধের সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জোগসাজশ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজমান অস্থিরতা ও বিভেদের কারণে রোহিঙ্গারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হতে পারে। একাধিক মহল এখানে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানই চায়। পরিবেশ ঘোলা করে, বিভেদ ও কোন্দল সৃষ্টি করে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করাই তাদের লক্ষ্য। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থেকে তৃতীয় পক্ষই লাভবান হবে।

শরণার্থীদের ঘিরে সবসময়ই দেশি-বিদেশি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী সক্রিয় থাকে। এসব জঙ্গী গোষ্ঠী ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের থেকে সদস্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে না, এ কথা বলা যায় না। পরদেশে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেবে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন মাদকের আখড়া। এসব কারণে রোহিঙ্গা যুবকদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

শরণার্থী-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের একটা ঠিকানা থাকলেও অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানসহ নানা অপরাধ ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।

কাজেই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অবস্থান একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। ১৯৭৮ সাল থেকেই এখানে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থায়ীভাবেই পুলিশি তৎপরতা চালাতে হবে। ১১ লাখ রোহিঙ্গার বিপরীতে যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ নিয়োজিত রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা। সাহায্যের পাশাপাশি এসব সংস্থা ভিন্ন কোনো এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে কি না সে ব্যাপারেও আমাদের পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থাকে খোঁজ খবর রাখতে হবে। অনেক সময় গুজব ছড়িয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারে কোনো কোনো মহল। যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গাদের অবস্থান বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি এখন আর নিছক একটি শরণার্থী সমস্যা হিসেবে নেই। বরং নিরাপত্তার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীকেন্দ্রিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার জাতিসংঘ সম্মেলনে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে এ নিয়ে কথা বলেছেন।

গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলনে তিনি রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয় নিয়ে কথা বলেন। গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ডি–৮ সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ডি-৮ নেতৃবৃন্দকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। সে সম্মেলনে তিনি নিরাপত্তার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেন।

শরণার্থী বিশেষজ্ঞরাও বর্তমানে নিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্বসহকারে দেখতে শুরু করেছেন। ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছেও নিরাপত্তা বিষয়টি এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। ২৬ অক্টোবর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দল। তারাও এখানকার আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

বিশ্বের যেখানেই শরণার্থী রয়েছে সেখানেই শরণার্থী-সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। করাচিতে বিহারি, লেবাননে ফিলিস্তিনি, পাকিস্তানে আফগান শরণার্থী ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারাও এর বাইরে নয়।

রোহিঙ্গাদের আগমন ও অবস্থানের ফলে বাংলাদেশ আজ নানা সমস্যার মুখোমুখি। এর মধ্যে নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্যাকে গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কাজেই যতদিন তাদের প্রত্যাবাসন না হয় ততদিন রোহিঙ্গাদের ওপর, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি সংগঠন বা সংস্থার ওপর, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বা অন্য যেকোনো গোষ্ঠী বা মহলের যেকোনো কর্মকাণ্ডের ওপর সরকারি নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আর এ সমস্যার একমাত্র আইনগত ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। প্রত্যাবাসনের পক্ষে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে সার্ক ও আসিয়ানকেও এগিয়ে আসতে হবে। নিরাপত্তার সংকট দেখা দিলে কেউ রেহাই পাবে না। নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর