বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রেজা-নুরের নতুন ‘দল’ কী করবে?

  •    
  • ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:০৩

বিরাট কর্মী বাহিনী এবং জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও রাজপথে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যা পারেনি বা পারছে না— রেজা ও নুরের দলের পক্ষে তা আরও কঠিন। কারণ জনসমর্থন গড়ে তোলাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তাছাড়া এই দলের প্রধান হিসেবে যিনি আছেন, সেই রেজা কিবরিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরীক্ষিত কোনো নেতা নন।

‘দল’ শব্দটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখার কারণ হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর এবং গণফোরোম থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতা রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বে নতুন যে দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, সেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘গণ-অধিকার পরিষদ।’ কোনো রাজনৈতিক দলের নাম ‘পরিষদ’ হয় কি না—সেটি একটি প্রশ্ন। সম্ভবত এই ‘পরিষদ’ শব্দটি এসেছে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ থেকে। যে সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন ভিপি নুর। নতুন এই দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মঞ্চেও ছাত্র অধিকার পরিষদের একাধিক নেতাকে দেখা গেছে। সুতরাং এই দলকে ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনৈতিক সংস্করণ বলা যায় কি না—সে প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক নয়।

নুর যে রাজনৈতিক দল গঠন করবেন, সেই আলোচনাটি অনেক দিন ধরেই ছিল। তবে এতদিন আলোচনাটি ছিল নুর ও সাকিকে নিয়ে। অর্থাৎ গণসংহগতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং নুরুল হক নুর মিলে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করবেন—এই আলোচনাটি গত ডিসেম্বরেও ছিল। কিন্তু সেখান থেকে সাকি হয়তো সরে গেছেন এবং নুরের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন রেজা কিবরিয়া। অবশ্য নুরের সঙ্গে রেজা নাকি রেজার সঙ্গে নুর— তাও আপাতত পরিষ্কার নয়।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে আলোচনায় আসা রেজা কিবরিয়া গণফোরাম থেকে সরে যাওয়া বা তাকে সরিয়ে দেয়ার পরে তিনি যে আওয়ামীবিরোধী কোনো ফোরামে যুক্ত হবেন— সেটিও শোনা যাচ্ছিল। সরাসরি আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে যোগ না দিয়ে ভিপি নুরের সঙ্গে তিনি যে নতুন দল গঠন করলেন— সেটির ভবিষ্যৎ কী, তা অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করছে। কারণ দল হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে গেলে তাকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়— যা খুব সহজ নয়।

একসময় আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনও নিবন্ধন পায়নি। সুতরাং যে নুর বিভিন্ন সময়ে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থতি তৈরি করেছেন; ডাকসুর ভিপি হওয়ার পরেও যিনি ক্ষমতামসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন— তার দল খুব সহজে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়ে যাবে, তা হয়তো নয়।

রেজা ও নুরের নতুন দলের স্লোগান ‘জনতার অধিকার আমাদের অঙ্গীকার।’ স্লোগান হিসেবে এটি খারাপ নয়। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণই রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক হলেও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে জনগণের সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে যে নির্বাচনে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই ভোটাধিকারই সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে। সুতরাং নতুন এই দল যদি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনতে কাজ করে বা করতে চায়— সেটি সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু কী করে তারা জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবে?

রাজপথে আন্দোলন করে নাকি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে? প্রসঙ্গত, দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী— যিনি সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও নানা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেন। তার মানে রেজা ও নুরের এই দলটি যে আওয়ামীবিরোধী জোটের সঙ্গেই ভবিষ্যতে যুক্ত হবে— সেটি ধারণা করা যায়। দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, নুর-রেজার এই নতুন দল ক্ষমতায় যেতে পারে বলেও তার ধারণা।

রাজনীতিতে নানা কারণে জোট হয়। তার মধ্যে প্রধান কারণ নির্বাচন। যেমন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও আটটি দল মিলে গঠন করেছিল ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। সেই জোটে জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনও ছিল। কিন্তু এবার রেজা ও নুর মিলে যে নতুন দল গঠন করলেন, তারা আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের বিপরীতে ভোটের রাজনীতিতে কতটুকু সুবিধা করতে পারবেন, তা এখনই বলা মুশকিল।

এটা ঠিক, এই দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেলেও একক দল হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে খুব বেশি জনসমর্থন পাবে না। সেক্ষেত্রে তারা হয়তো রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সঙ্গে জোট করবে। সেই জোটও নির্বাচনে কতটা আসন পাবে, তার পুরোটাই নির্ভর করবে নির্বাচনটি কোন সরকারের অধীনে এবং কোন প্রক্রিয়ায় হবে।

গত দুটি নির্বাচনের মতো হলে বিএনপি এবং তার শরিকরা মিলে যে গোটা দশের বেশি আসন পাবে না, সেটি একাদশ জাতীয় নির্বাচনেই টের পাওয়া গেছে। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে নতুন দল আত্মপ্রকাশের দিনই রেজা কিবরিয়া জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জাতিসংঘের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান যে মোটেও সম্মানজনক নয়, সেটি নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না।

আবার বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার) নির্বাচনেরও সুযোগ নেই। উপরন্তু একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যেরকম নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত থাকতে হয়, সেটিও তারা কতটা থাকতে পেরেছেন এবং পারবেন— তাও প্রশ্নাতীত নয়। ফলে কে কোন দল গঠন করলেন, দলটি নিবন্ধন পেল কি পেল না, তারা এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠন করবে— সেই আলোচনার কোনো অর্থই হয় না যদি নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে যেসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেগুলোর সুরাহা করা না যায়।

কথা হচ্ছে, রেজা ও নুর যে দলটি গঠন করলেন, তাদের উদ্দেশ্য কি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া নাকি নির্বাচনি ব্যবস্থা ঠিক করতে আন্দোলন গড়ে তোলা? এরকম একটি দল কি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে? ছাত্র অধিকার পরিষদের আদলে দলটির নামের সঙ্গে ‘পরিষদ’ শব্দটি যুক্ত রাখা হয়েছে কি কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো শিক্ষার্থীদের নিয়ে নির্বাচনি ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার আন্দোলন গড়ে তোলার টার্গেট থেকে? সেটি কি আদৌ সম্ভব হবে?

কারণ বিরাট কর্মী বাহিনী এবং জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও রাজপথে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি যা পারেনি বা পারছে না— রেজা ও নুরের দলের পক্ষে তা আরও কঠিন। কারণ জনসমর্থন গড়ে তোলাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তাছাড়া এই দলের প্রধান হিসেবে যিনি আছেন, সেই রেজা কিবরিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরীক্ষিত কোনো নেতা নন।

আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে রেজা কিবরিয়া পৈতৃক এলাকা হবিগঞ্জের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।

রেজা কিবরিয়া মূলত ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামে যোগ দেন ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর। তাকে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়। এর ৬ মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ৫ মে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিলে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সরিয়ে রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। যদিও পরে রেজা কিবরিয়াসহ চারজনকে বহিষ্কার করে জাতীয় কাউন্সিলের ঘোষণা দেয় গণফোরামের একাংশ। সবশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি রেজা কিবরিয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, তিনি গণফোরাম থেকে পদত্যাগ করেছন।

অপরদিকে নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি হওয়ার আগে থেকেই সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে। বলা চলে, এই নেতৃত্বই তাকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের ভিপি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

ভিপি হওয়ার পর থেকেই তিনি একাধিক ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে যেভাবে প্রতিনিয়ত মার খেয়েছেন— সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল। তার মতো আর কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি থাকা অবস্থায় এরকম মার খেয়েছেন বা নাজেহাল হয়েছেন— এমন নজির নেই।

মজার ব্যাপার হলো, রেজা ও নুরের দল যেদিন আত্মপ্রকাশ করল, সেদিনই অর্থাৎ গত মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। তারা এই দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদকে ‘জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হামলায় মদদ দেয়ার অভিযোগ তুলে রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুরকে গ্রেপ্তারেরও দাবি জানান।

পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনও তিন বছরের বেশি সময় বাকি। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ ভেঙে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সুতরাং এর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি। ফলে এর পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে যেকোনো দিন নির্বাচন হতে হবে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিন বছর আগেই রাজনীতির মাঠে নির্বাচনের হাওয়া এবং দেশের বড় দুই দলের নেতারাও নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলছেন। এরকম বাস্তবতায় রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুর যে নতুন দল গঠন করলেন এবং আত্মপ্রকাশের দিনই তাদের দল নিষিদ্ধ করা এবং তাদের গ্রেপ্তারের যে দাবি জানানো হয়েছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে এই দলটিকে নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে— তাতে সন্দেহ নেই।

বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে গিয়ে তাদের হয়তো উচ্চ আদালতেও যেতে হতে পারে। কিন্তু যে জনগণের অধিকার আদায়ের স্লোগান নিয়ে দলটি আত্মপ্রকাশ করল, সেই অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তারা আখেরে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে— সেটি নির্ভর করবে অনেকগুলো ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র উপরে।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর