বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইকবাল যেন না হন জজ মিয়া

  •    
  • ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৯:১৭

ইকবাল যদি আসলেই অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যে কেবল মাঠের অ্যাসাইনমেন্টই বাস্তবায়ন করেছেন এবং তার পেছনে যে বিরাট শক্তি রয়েছে— তাতে সন্দেহ নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সাংবাদিকদের বলেছেন, কাজটি পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছে। দুই থেকে তিনবার যাওয়া– আসার মধ্যে তিনি এই কর্মটি শেষ করেছেন। কাজেই এটি নির্দেশিত হয়ে কিংবা কারো প্ররোচনা ছাড়া এটি করেছেন বলে তারা এখনও মনে করেন না।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তার সমাবেশে যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়, সেই মামলার তদন্ত ভিন্নখাতে নিতে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় জজ মিয়া নামে এক যুবককে। তাকে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে সিআইডি। ২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনও গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না।

পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। তবে এই জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে। পরের বছর ২০০৬ সালের আগস্টে আসল ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম। তিনি জানান, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অব্যাহতি দেয়া হয় জজ মিয়াকে।

রাষ্ট্র কীভাবে একটি বড় ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে এবং আসল ঘটনা আড়াল করতে জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে— একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় এই জজ মিয়া নাটক তার একটি বড় কেস স্টাডি। এটি ওই সময়ে এত বেশি আলোচিত হয় যে, এখনও বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স হিসেবে জজ মিয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে নারকীয় তাণ্ডবের পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে জানানো হচ্ছে যে, যে লোক পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রেখে এসেছিলেন, তার নাম ইকবাল। এরইমধ্যে তাকে গ্রেপ্তারের খবরও জানানো হয়েছে। যদিও ইকবালের পরিবার বলছে, ইকবাল ভবঘুরে, মানসিকভাবেও পুরোপুরি সুস্থ নন। কেউ কেউ বলছেন, ইকবাল ভবঘুরে হলেও আগে বিএনপি-জামায়াতের মিছিলে তাকে দেখা গেছে। তবে যে দাবিটি সবচেয়ে বেশি সামনে আসছে তা হলো, ইকবাল যেন বলির পাঁঠা বা আরেকজন জজ মিয়া না হন।

যেন এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেকে এবং এই ঘটনার পেছনে যদি দেশি-বিদেশি চক্রান্ত থেকে থাকে; যদি বড় কোনো গোষ্ঠী বা দল এমনকি কোনো রাষ্ট্রও জড়িত থাকে— সেই সত্যটা যেন বেরিয়ে আসে। যেন পুরো ঘটনাটি ইকবালকেন্দ্রিক না হয়। কারণ আপাতদৃষ্টিতে ইকবাল সম্পর্কে যতটুকু জানা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, তিনি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে এই কাজটি করেনননি। বরং নগদ কিছু টাকার বিনিময়ে হয়তো তাকে দিয়ে একটি মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে পূজামণ্ডপে রাখা হয়েছে।

সিসি ক্যামেরার যে ছবি এরইমধ্যে গণমাধ্যমে দেখা গেছে, সেটি যদি সত্যি হয় এবং ইকবাল নামে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনিই যদি পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে আসেন—তাহলে তার কাছ থেকে জানতে হবে তিনি কার নির্দেশে বা কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন? এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যাকে ধরা হয়েছে তিনি প্রকৃতই অপরাধী কি না; মূল অপরাধীদের ধরতে না পারা বা তাদের আড়াল করতে ইকবালকে সামনে আনা হচ্ছে কি না; জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল সঠিক তথ্য দেবেন কি না; যদি তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ না হন, তাহলে তার দেয়া তথ্য কতটুকু আমলযোগ্য হবে ইত্যাদি নিয়েও সংশয় রয়েছে।

কুমিল্লার এই ঘটনার পর থেকেই বলা হচ্ছিল যে, ওই পূজামণ্ডপের সিসি ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু ঘটনার কয়েক দিন পরে জানা গেল যে, মন্দিরের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই এই ভিডিও ফুটেজের সত্যতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। সংশয় প্রকাশ করেছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ এমনও লিখেছেন যে, মন্দির থেকে যখন লোকটি বের হয়ে আসছেন, তখন তিনি সাবলিল ভঙ্গিতে আসছেন এবং তার হাতে সাদা উজ্জ্বল একটা বইয়ের মতন। কিন্তু মণ্ডপ থেকে যে কোরআন শরিফ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটির কাভার ছিলো সবুজ। আবার হনুমানের গদা নিয়ে হাঁটার সময় মনে হয়নি তিনি গোপন কোনো কাজ করছেন। এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আছে এই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে।

এখন কথা হচ্ছে, মানুষ কেন এই ফুটেজ নিয়ে সন্দেহ করছে বা এরকম ঘটনায় জনগণের একটি বিরাট অংশ কেন সংশয় প্রকাশ করে? করে এই কারণে যে, যখনই কোথাও বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে, সেখানে অনেক সময়ই গণমাধ্যম সঠিক সময়ে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য জনগণকে দিতে ব্যর্থ হয়; অনেক সময় গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় নানা বাহিনীর তরফে চাপ প্রয়োগ করা হয় আবার গণমাধ্যম নিজেও নানারকম সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে তথ্য গোপন করে বা চেপে যায়। তখন সংগত কারণেই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও অপতথ্য ডালপালা মেলে। ফলে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে কোনো ফলোআপ দেয়া হয় বা অপরাধী সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়া হয়, তখন অনেক মানুষই সেগুলো সন্দেহের চোখে দেখে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ব্যাপারে মানুষের আস্থার সংকটও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। বছরের পর বছর ধরেও অনেক আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার কূলকিনারা না হওয়ায় এই সংকট আরও বেড়ে যায়। যেমন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি বা কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পরে হত্যার ঘটনা।

অনেক ঘটনা বা মামলাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার; রাজনীতি ও ভোটের মাঠে বিরোধীপক্ষ দমনের জন্য গ্রাউন্ড বা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা; একপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়ে দেয়া; বিচারিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে দেশের পুরো সিস্টেম নিয়ে জনমনে আস্থার সংকট রয়েছে। যে কারণে ইকবাল নামে একজন যুবককে কুমিল্লার ঘটনায় সামনে নিয়ে আসা হলো, সেই লোকটি প্রকৃত প্রস্তাবে অপরাধী হলেও সমাজের বিরাট অংশ এটিকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল। এটি খুবই বিপজ্জনক।

রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার তথা সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার একটি বড় শর্ত হলো- সেই বিচারব্যবস্থায় জনগণের পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে। সেই রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা থাকতে হবে। তারা যে প্রতিবেদন দেবে, সংবাদ সম্মেলনে যে তথ্য দেবে, মানুষের কাছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। কিন্তু এই বিশ্বাস ও আস্থা একদিনে তৈরি হয় না। এই বিশ্বাস ও আস্থা একদিনে নষ্ট হয়নি। জজ মিয়ার মতো নাটক এই দেশে হয়েছে বলেই এখন কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে আসার অভিযোগে গ্রেপ্তার ইকবালের প্রসঙ্গেও অনেকে সেই একই শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

মোদ্দা কথা, ইকবাল যদি আসলেই অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি যে কেবল মাঠের অ্যাসাইনমেন্টই বাস্তবায়ন করেছেন এবং তার পেছনে যে বিরাট শক্তি রয়েছে— তাতে সন্দেহ নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সাংবাদিকদের বলেছেন, কাজটি পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছে। দুই থেকে তিনবার যাওয়া– আসার মধ্যে তিনি এই কর্মটি শেষ করেছেন। কাজেই এটি নির্দেশিত হয়ে কিংবা কারো প্ররোচনা ছাড়া এটি করেছেন বলে তারা এখনও মনে করেন না।

বাস্তবতা হলো, যারাই এই ঘটনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন, তারা জানতেই যে এটি বড় ইস্যু হবে এবং এটা নিয়ে একটা বড় ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় সংকট সৃষ্টি করা হবে। হয়তো সেই সামাজিক ও ধর্মীয় সংকটকে পুঁজি কের কেউ কেউ তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও করে থাকতে পারেন। কিন্তু আসলেই কী ঘটেছিল, সেটি নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বের করে আনার জন্য রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীসহ পুরো সিস্টেমকে যেরকম দক্ষ, যোগ্য, পক্ষপাতমুক্ত হওয়া দরকার—সেখানেই বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নানারকম ষড়যন্ত্র থাকলেও সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে সাধারণ মানুষেরই বিরাট অংশ। যারা মিছিল নিয়ে মন্দিরে ভাঙচুর চালিয়েছে বা যারা রংপুরে জেলেপল্লিতে আগুন দিয়েছে, তাদের সবাই রাজনৈতিক কর্মী নন। এখানে অনেক সাধারণ মানুষও আছেন— যারা কথিত ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই এই সহিংসতায় অংশ নিয়েছেন। মানুষ হিসেবে আমাদের অসহিষ্ণুতার পারদ যে দিন দিন উপরে উঠছে; পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ভিন্নমত-ভিন্ন আদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা যে দিন দিন কমছে, এ কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই।

রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নানা গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করবে; সরকারের বিরোধীপক্ষ সরকারকে বিপদে ফেলতে বা বিব্রত করতেই চাইবে। কিন্তু তাদের সেই চাওয়াটা সাধারণ মানুষই বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে। সুতরাং একজন ইকবালকে ধরে তো কোনো লাভ নেই কিংবা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধরেও খুব বেশি লাভ হবে না— যদি সমাজের মানুষের মধ্যে যে কট্টরপন্থার বীজ ক্রমশ বাড়ছে— সেটি উপড়ে ফেলা না যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর