বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাম্প্রদায়িকতার অন্ধত্ব নয় মানবিকবোধসম্পন্ন হতে হবে

  •    
  • ২০ অক্টোবর, ২০২১ ১৬:২৬

এরা শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীই যদি হবে তবে ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকানোর সন্ত্রাসী আয়োজনের সময় শিবিরের আস্তানায় পেট্রোলবোমা, গানপাউডার আর ককটেল পাওয়া যাবে কেন? কেন সিতাকুণ্ডের পাহাড়ে শিবির মানুষ হত্যার জন্য, সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলবে? কেন সেখানে ধারালো ও আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ পাওয়া যাবে? ধর্মের নাম ভাঙিয়ে চলা এসব লোভী মানুষ ধর্ম ও সভ্যতার শত্রু।

সচেতন আর বিবেকবান মানুষেরা আতঙ্কিত ও বিস্মিত এই জন্য যে, একুশ শতকের এ অগ্রগতির যুগে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে কীভাবে একদল মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে মাঠে নেমেছে। এদেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ক্যানভাসের কথা এসব অন্ধকার জীবের জানা নেই। ১৩ শতক থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদেশে বহিরাগত মুসলিম- সুলতান ও মোগলরা শাসন করেছে। সুফি-সাধকরা ধর্মপ্রচার করেছে মানবতার বাণী ছড়িয়ে।

ইসলামের শান্তির বাণী ও মানবিক আচরণ আকৃষ্ট করে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের অত্যাচারে বিপন্ন সাধারণ হিন্দুকে। সুফির কাছে এসে তারা বেঁচে থাকার আশ্বাস পেতে চেয়েছে। অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পৃষ্ঠপোষকতা পেত মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বন্ধুর মতো পাশাপাশি বাস করত। একে অন্যের প্রয়োজনে ছুটে আসত।

এখনও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি নেই। হঠাৎ সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকে দেয়া দেখে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে সব অপকাণ্ডের সূত্র হচ্ছে নষ্ট রাজনীতি। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে সমাজকে বিপন্ন করে তুলছে সুবিধাবাদী কিছু মানুষ।

গণতান্ত্রিক পথচলার পরিক্রমা নষ্ট করে ফেলেছে বিভিন্ন পক্ষের রাজনীতিকরা। সরল পথে কেউ হাঁটতে পারছে না। নিয়মতান্ত্রিক পথে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকলে রাজনীতিতে এত হতাশা নেমে আসত না। তাই সরল পথ না পেয়ে মোক্ষ লাভের জন্য অন্ধকার পথ খুঁজতে হচ্ছে সব পক্ষকে।

এমন বাস্তবতায় নৈরাজ্য দানা বাধবেই। এসবের মধ্যে আবার এ আধুনিক সময়ে নানা নামে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটছে। পাকিস্তান আমলেও ধর্ম নিয়ে এমন ফিতনা-ফ্যাশাদ ছিল না। গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় গজিয়ে ওঠা অসংখ্য মাদ্রাসায় তৈরি করা হচ্ছে মৌলবাদীদের তালেবে এলেম। দায়িত্বশীল মাদ্রাসার প্রকৃত ইসলামচর্চাকারী আলেম ও শিক্ষার্থীরা এদের দাপটে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় এদের বিভ্রান্ত করে অন্যায়ের পথে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এসবের ভেতর থেকে একে একে ঘটে যাচ্ছে রামুর বৌদ্ধদের ওপর আঘাত হানা, নাসিরনগরে হিন্দুদের জীবন ও সম্পদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িকতার কূটচালে নাটক সাজানো।

জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৃতিত্ব এসব ঘটনায় অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। গোয়েন্দাদের দুর্বলতা এখন আর লুকোছাপা নেই। কুমিল্লার ঘটনার আগে কোনো পক্ষ আঁচ করতে পারেনি- তা না হয় মানা যায় কিন্তু এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া যে হতে পারে তা না ভাববার কারণ কী? রংপুরের জেলেপল্লিতে এতবড় তাণ্ডব ঘটে গেল অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুই আঁচ করতে পারল না! ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ভাঙা রেকর্ড বাজতে থাকে। খুঁজে বের করবে, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে... ইত্যাদি।

ধর্মীয় মৌলবাদীরা ও রাষ্ট্রক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনীতিকরা অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ক্ষমতার মোহে যুগ যুগ ধরে সরল মানুষদের ধর্মান্ধ জঙ্গি বানাতে চেষ্টা করেছে। এই সরল মানুষদের মুক্তবুদ্ধি আর চেতনার সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। একচোখা গণ্ডারের মতো অন্ধ বানিয়ে ছেড়েছে মানবতা ও সভ্যতার বক্ষ বিদীর্ণ করতে।

ব্যক্তিগত লাভের ফসল ঘরে তুলতে নিজধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। খ্রিস্ট-সনাতন, ইসলামসহ অন্যসব ধর্মের নামাবরণে এ ধারার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অশুভ অবস্থান দেখা গিয়েছে, যাচ্ছেও। বিশ্বজুড়ে এসময় ইসলামের নাম ভাঙানো জঙ্গিবাদ শান্তিবাদী মানবিক ধর্ম ইসলামকে ভুলভাবে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করছে।

আমাদের দেশে লেবাস ও বর্ণিত আদর্শে জামায়েতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির ইসলামের নাম নিয়েই রাজনীতি করে। এখন যদিও নিজ অপকর্মে এই দল দুর্বল হয়ে গেছে। এরা কি কম আসুরিক কাজ করেছে? এই দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য চরম ইসলামবিরোধী কাজ করে যাচ্ছিল অবলীলায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা নিজেদের আদর্শিক কারণে পাকিস্তানপন্থি হতেই পারে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান না-ও নিতে পারে। তাই বলে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হয়ে গণহত্যায় অংশ নেবে? ধর্ষণের সহযোগী হবে? নিরীহ-নিপরাধ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে? ইসলামের দৃষ্টিতে তো এসব আচরণ ঘোরতর পাপের কাজ। ইসলামী ছাত্র শিবির যখন প্রতিপক্ষ ছাত্রবন্ধুকে হত্যা করে, পায়ের রগ কেটে দেয় এর কি কোনো অনুমোদন পাবে ইসলামে? কবছর আগেও আন্দোলনের নামে বিএনপির বন্ধু হয়ে যেভাবে নিরীহ সাধারণ মানুষকে পেট্রোল বোমায় পোড়াচ্ছিল এর অনুমোদন কোথায় ইসলাম ধর্মে?

এরা শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীই যদি হবে তবে ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকানোর সন্ত্রাসী আয়োজনের সময় শিবিরের আস্তানায় পেট্রোলবোমা, গানপাউডার আর ককটেল পাওয়া যাবে কেন? কেন সিতাকুণ্ডের পাহাড়ে শিবির মানুষ হত্যার জন্য, সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলবে? কেন সেখানে ধারালো ও আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ পাওয়া যাবে? ধর্মের নাম ভাঙিয়ে চলা এসব লোভী মানুষ ধর্ম ও সভ্যতার শত্রু। এসব বিচারে ইসলামী স্টেটস নামধারী জঙ্গি থেকে শুরু করে জামায়েতে ইসলামী এবং ইসলাম নামধারী নানা জঙ্গি ভাবাদর্শের দল সবাই একসূত্রে গাঁথা।

ইন্টারনেটের কল্যাণে পাঠক নিশ্চয়ই বেশ কবছর আগে বর্বর জঙ্গিদের মসুল জাদুঘরে রাখা এশেরীয় সভ্যতার মহামূল্যবান নিদর্শনগুলো নির্দয়ভাবে হাতুড়ি চালিয়ে ভেঙে ফেলতে দেখেছিলেন! চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল হাতুড়ির প্রতিটি ঘা বুকের একটি করে পাঁজর ভেঙে ফেলছে। সেই মধ্যযুগে আব্বাসীয় শাসনপর্বে বাগদাদ ছিল ইসলামি সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি।

এখানে আক্রমণ করেছিল মঙ্গোলীয় বর্বর নেতা হালাকু খান। পুড়িয়ে দিয়েছিল বাগদাদের জাদুঘর আর লাইব্রেরি। এখনও ঘৃণাভরে সে বর্বরতার কথা স্মরণ করে পৃথিবীর সংস্কৃতিসচেতন মানুষ। এই আধুনিক যুগে এসেও ইসলামি রাজ্য গড়ার কথা বলে ইসলামের উদারতা ও গরিমাকে কলঙ্কিত করে বিশ্ববাসীর কাছে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করছে কিছু ধর্মান্ধ মানুষ। এজন্যই বুঝি বলে ধার্মিক মানুষ সবসময় মানবিকতার পক্ষে আর মানবতা ও ধর্মের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ধর্মান্ধ মানুষ। কারণ অন্ধ রেখে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে এদের দিয়ে যেকোনো অপকর্ম করানো যায়।

২০০১-এর কথা কি আমরা ভুলতে পেরেছি? আফগানিস্তানের তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের ফরমান মতো বামিয়ান উপত্যকায় অনিন্দ্য সুন্দর বৌদ্ধ ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়েছিল মূর্খ, উন্মাদ তালেবান জঙ্গিরা। ২০০৮-এর কথা; হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বরাবর মূল সড়কের সড়কদ্বীপে লালন ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। সে ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে মৌলবাদীরা। এদেশের মৌলবাদী ইসলামি নেতারা কতটা গভীরভাবে নিজধর্মকে বোঝে জানি না, তবে তারা যে অসংখ্য ধার্মিক মুসলমানকে ধর্মান্ধ বানিয়ে ইসলামের কমনীয় রূপে কালিমা লেপন করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গভীরভাবে ইসলাম ও ইতিহাস না বুঝতে পারায় সম্ভবত অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী লালনকে এ যুগের মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষরা চিনতে পারল না। যে মরমি সাধক লালন আল্লাহর সঙ্গে নিজের হৃদয় এক করে দিতে চেয়েছিলেন, তাকে প্রতীক হিসেবে ধারণ করে আমরা প্রতিদিন শুদ্ধ হতে পারতাম। এর বদলে কিছু অশিক্ষিত, অসংস্কৃত, অমার্জিত মানুষ বোকা ছাত্রদের উসকে দিয়ে লালন ভাস্কর্যকে পায়ের তলায় পিষে ফেলতে চাইল। এদের কাছে কি মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য স্পষ্ট নয়?

নিরাকার আল্লাহর প্রতিরূপ যাতে কেউ না দেয় সে অর্থে মূর্তি গড়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য আছে ইসলামে। ভাস্কর্য তো সৌন্দর্যের প্রতিরূপ, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতিরূপ। এর প্রতি হিংসা প্রকাশ করতে পারে একমাত্র অন্ধকারের জীবরা।

এশেরীয় সভ্যতার নিদর্শনসমূহের ভেতর একটি বড় অহংকার শিল্প সৌকর্যে পূর্ণ ভাস্কর্য। প্রায় ৩ হাজার বছর আগের নাম না জানা শিল্পীরা কতটা নৈপুণ্যে গড়ে তুলেছিল এসব শিল্প। তা দেখে শিল্প ইতিহাসের মূল্যায়ন করবে এযুগের মানুষ। অথচ একমুহূর্তে জঙ্গির তকমা আঁটা কিছু অন্ধ উন্মাদ এই মহামূল্যবান প্রত্নঐতিহ্য নির্দয়ভাবে গুড়িয়ে দিল।

ইরাকের নিমরুদ শহরের এসব ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ার পর আরেকটি প্রাচীন শহর হাত্রার স্থাপত্যসমূহ ভেঙে ফেলে জঙ্গিরা। বুঝলাম এরা ভাস্কর্যকে পূজ্য মূর্তি বিবেচনায় ভেঙেছে। যেমন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে চেয়েছিল। আসলে অন্ধকারের জীবরা আলোকে সবসময় ভয় পায়। এদের কাণ্ড দেখে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আর্যদের কথা মনে পড়ল।

তাদের গ্রন্থ বেদের ভাষ্য থেকে জানা যায়, গ্রামীণ-সংস্কৃতির ধারক আর্যরা ভারতে ঢুকে সিন্ধু সভ্যতার দুর্গ নগরী দেখতে পায়। নগরীকে ভীতিকর মনে করে। তাই তাদের দেবতা ইন্দ্র ‘পুর’ অর্থাৎ নগর ধ্বংস করে দেয়। একারণে আর্যরা গর্ব করে দেবতা ইন্দ্রকে বলেছে ‘পুরন্দর’। অর্থাৎ পুর ধ্বংসকারী দেবতা।

দেখা যাচ্ছে মেসোপটেমিয়া থেকে বাংলাদেশ সর্বত্রই ধর্মান্ধরা তাদের ছড়ানো উন্মাদনায় শুধু সভ্যতার শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত হয়নি, এরা নিজধর্মেরও শত্রু। নিজেদের ক্ষমতার লোভ এবং ধর্মকে ভুল ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করে কলঙ্কিত করছে ধর্মের ঔজ্জ্বল্য। একারণে সুস্থ চিন্তার সব মানুষকেই প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে।

আসলে আমরা মনে করি হিংসাকে বন্ধ করতে হিংসা ছড়ানো নয়। মানবিকতার আহবানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যারা আজ কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রংপুরে নিরীহ হিন্দুদের ওপর আঘাত হেনেছে, তাদের সম্পদ ধ্বংস করেছে, তারা যাতে মানবিকতার আহবানে সুন্দরের দিকে ফিরে তাকায় তেমন পরিবেশ রচনা করতে হবে। মতলববাজ গুরুরা এসব তরুণের কাঁচা মাথা চিবানোর আগেই সমাজের সচেতন মানুষকে সুন্দর ও যুক্তির পথ রচনা করতে হবে। একটি মানুষ মানবিকবোধসম্পন্ন হলে তাকে অন্ধকারের পথে নেয়া সহজ হবে না।

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর