এত যে বিষাদ চারধারে! উত্তুরে হাওয়া যেন হাহাকার করছে। অথচ দিনটি তো এমন হবার কথা ছিল না। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গতকাল যে দেবশিশুর আগমন হয়েছিল তার জন্মোৎবের আলোকচ্ছটা মেঘে মেঘে ভেসে বেড়াবার কথা ছিল। কথা ছিল তেতুলিয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিয়ে যাওয়ার। কীভাবে এই দিনটিকে বরণ করি আমরা?
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসের কলংকজনক হত্যাকাণ্ডের শিকার সেই দেবশিশুর হত্যাকারী আমরা নিজেরাই। ১৯৬৪-এর ১৮ অক্টোবর দিনটি চিরদিনের জন্য বিষাদ ভরা হয়ে থাকবে। দেবশিশুর ৫৭ তম জন্মদিন গেল গতকাল। কিন্তু কোথাও কোনো আলো নেই। সেসময় কতইবা বয়স ছিল তার? অথচ ঘাতকের বুক একটি বারের জন্যেও কাঁপল না।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা বাংলাদেশকে ছায়া পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে শিশু রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। শেখ রাসেল বারবার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। আকুতি করেছিলেন, আমি মায়ের কাছে যাব বলে। তার কান্নায় পাথর হয়তো গলে যায়। কিন্তু ঘাতকের নিষ্ঠুর মন গলেনি। তাদেরই একজন ‘মায়ের কাছে চল’ বলে দোতলায় নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে। টেনে হিঁচড়ে উপরে নেয়ার সময় রাসেল ভয় পেয়ে বলেছিলেন, আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন। চিরতরে হারিয়ে যায় হাসু আপার কলিজার টুকরা। মা ফজিলাতুন নেসা মুজিবের নাড়ি ছেঁড়া ধন।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা দুজনেই ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। তার নামেই রেখেছিলেন ছোট্ট রাসেলের নাম। রাসেলের জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। যেকারণে শিশু রাসেল বাবাকে ভালোভাবে চিনতেন না।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনের যে রাস্তায় রাসেল সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন সে রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে আমি বহুবার রাসেলের কথা ভেবেছি। রাস্তাটাকে বহু লোকের সমাগমেও আমার কাছে নিঃসঙ্গ লাগে। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো নিশ্চয়ই কাল সারাদিন অপেক্ষা করেছিল রাসেলের জন্য।
ছোট রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাড়ার আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই তিনি স্কুলে যেতেন। ছোট ছেলেটি যেন বাবা, মা আর বড় ভাই-বোনদের অনুসরণ করছে। কলাভবন থেকে বাসায় ফেরার পথে রাসেলের স্কুলের সামনে মাঝেমধ্যে দাঁড়াই। মনে মনে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। কীভাবে সম্ভব একটি শিশুর শৈশব লুন্ঠন করা?
রাসেলের ৫৪ তম জন্মদিনেও যেন বয়স বাড়ে না। তার বয়স ১০ বছরে আটকে গেছে। একটি শৈশব লুণ্ঠনের কী শাস্তি হতে পারে? আমি ভেবে পাই না। আমি পরিমাপ করতে পারি না, সেই শাস্তির ওজন! আমি কোনো দাঁড়িপাল্লায় মাপতে পারি না ঘাতকের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমার চোখের বিচ্ছুরিত ঘৃণাকে।
ক্ষমতালোভী ঘাতকেরা চাপা দিতে চেয়েছিল যে আলোকরশ্মি তাতে তারা সক্ষম হয়নি। ১৯৯৬ সালে বহুবছর অমাবস্যায় ঢাকা চাঁদ আবার কিরণ ফিরে পায় শেখ হাসিনার নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে।
১৯৯৬ সালে আমি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের ঘরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর বিশাল একটা ছবি ছিল। আমার বাবার মুখে ইতিহাস শুনতে শুনতে আমার বড় হওয়া। বাবার মুখে শুনেছি ১৫ আগস্টের ভয়াবহ রাতের কাহিনী। বাবাই বলেছেন শেখ রাসেলকে নির্মম ভাবে হত্যা করার কাহিনী। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। ১০ বছরের সেই শান্তা মনে মনে রাসেলকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুর হাত। মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভেবেছে, মায়ের কাছে রাসেলকে যেতে না দেয়ার বেদনা। খেলতে গিয়ে পরে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ার পর ভেবেছে, যখন ঘাতকের বুলেট রাসেলের বুকটাকে ভেদ করে বেরিয়ে গেছে তখন কতখানি বেদনার কুকড়ে গেছে দেব শিশুর মুখটা…!
আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি করতেন। বাবার মুখে শুনেছি ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ আর শেখ মুজিবের কথা। আমার বাবার নেতা শেখ মুজিব কবে কোনদিন আমার নেতা মুজিব হয়ে ওঠেন আমি জানি না। খুব গর্ব হয় আমার বাবাকে নিয়ে। মাঝেমধ্যে ভাবি যদি শেখ রাসেল বেঁচে থাকতেন, তিনিও নিশ্চয়ই তার বাবা শেখ মুজিবকে নিয়ে আমার মত গর্ব করতেন। কেন জানি না মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। রাসেল কি কোনোদিন ক্ষমা করবেন আমাদের?
লেখক: চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।