হাসুপার আদরের রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। কিন্তু মাত্র ১১ বছর বয়সেই ঘাতকের বুলেটে তাকে প্রাণ হারাতে হয়। কুঁড়িতেই শেষ হয়ে যায় একটি ফুল। আচ্ছা, আজ বেঁচে থাকলে দেখতে কেমন হতেন তিনি? ৫৭ পেরিয়ে ৫৮ বছরে পা দিতেন। পুরোদস্তুর মধ্যবয়স্ক এক পুরুষের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হতেন। সেই গোঁফওয়ালা ভরাট কণ্ঠের রাশভারী চেহারা নাকি আরেকটু ভিন্ন কোনো অবয়ব?
তা যাই হোক, আদল দেখলে নিশ্চিত বোঝা যেত- এ আর কেউ নন, জাতির পিতারই এক প্রতিচ্ছবি। হয়তো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে থাকত। কারণ, দেশ পরিচালনা ও রাজনীতির সৎ রক্ত যে তার শরীরে। আবার পিতার প্রিয় বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো পৃথিবীখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানীও হতেন হয়ত। কিংবা নিজের ইচ্ছা ছিল আর্মি অফিসার হওয়ার, তাহলে জাঁদরেল সেনাবাহিনীর জেনারেলেই হতেন নিশ্চিত। এটা হয়তো আমার স্বপ্ন, আক্ষেপের কথা। অনেকটা সে কালজয়ী গানের মতো-
‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’…।
সময়টা ছিল ১৯৬৪ সাল। দেশজুড়ে তখন ক্রমে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ। বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন মুক্তিকামী জাতিকে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করতে। সেসময়ের রাজনৈতিক নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে ছুটে চলছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অপরদিকে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের তত্ত্বাবধানে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কেও চলছিল বাড়ি নির্মাণের কাজ। এমন এক কর্মমুখর সময়ে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন সদ্য ভূমিষ্ট এক শিশু।
আদরের রাসেলের জন্মের কথা স্মরণ করে তার বড় বোন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করেন-
“রাসেল যেদিন জন্ম নিয়েছে, সেদিনের কথাটা এখনো আমার মনে পড়ে। একটা ছোট্ট শিশু আসবে, আমাদের পরিবারে, আমি কামাল-জামাল, রেহানা- আমরা সবাই খুব উৎসাহিত এবং বেশ উত্তেজিত ছিলাম, কখন সেই শিশুটির কান্না আমরা শুনবো, কখন তার আওয়াজটা পাবো, কখন তাকে কোলে তুলে নেবো। আর সেই ক্ষণটা যখন এলো, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের সময় ছিল। ছোট্ট শিশুটি আমাদের সবার চোখের মণি ছিল।”
শৈশবে বাবাকে কাছে না পাওয়ায় ছোট্ট শিশু রাসেলের বেদনার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন-
“কী দুর্ভাগ্য তার, ৬৪ সালের অক্টোবরের ১৮ তারিখ তার জন্ম। এরপর ’৬৬ সালে আবার বাবা যখন ৬ দফা দাবি দিলেন- তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ’৬৬ সালের মে মাসে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বন্দি হয়ে গেলেন। ছোট্ট রাসেল কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবা কারাগারে। যখন সে একটু বড় হলো, তখন কারাগার থেকে বাবাকে কীভাবে নিয়ে আসবে, সে জন্য বাড়ি চল, বাড়ি চল বলে কান্নাকাটি করতো।”
বড় দুই বোন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্নেহে আদরে শুরু হয় রাসেলের জীবনের পথ চলা।
বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন রাসেল। এই নামকরণে মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শৈশব থেকেই দুরন্ত প্রাণবন্ত রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার অতি আদরের। কিন্তু মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই প্রিয় পিতার সঙ্গে তার সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তবে ৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে তিনি নিজেই বন্দি হয়ে যান।
রাসেলের জন্মের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে জেলবাস করতেন। তাই রাসেলের ভাগ্যে তার বাবার সান্নিধ্য খুব কমই হয়েছে। রাসেলের সব থেকে প্রিয় সঙ্গী ছিল তার হাসুপা। রাসেলকে নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’র ২৭ মে এবং ২৮ মে ১৯৬৭ সালের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে ৬ দফা মানতে হবে, সংগ্রাম, সংগ্রাম, চলবে চলবে(…) ভাঙা ভাঙা করে বলে কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ও শিখল কোথা থেকে। রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে।” কারাগারের রোজনামচায় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন-
“৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দেব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কী বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন-
“আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।”
বড় হয়ে আর্মি অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন শেখ রাসেল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাসেলের এই ইচ্ছা মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। এ থেকেই বড় দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তাদের কাছ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে যুদ্ধের গল্প শুনতেন।
‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেল সম্পর্কে আরও লিখেছেন- “রাসেল একবার আমার কোলে, একবার তার মার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিক ওদিক হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, ‘আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে।’ আমি ওকে বললাম, ‘তুমি রেহানাকে মার?’ রাসেল বলল, ‘হ্যাঁ মারি।’ বললাম, ‘না আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিল, ‘মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না।”
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে মাত্র ১১ বছর বয়সের প্রাণবন্ত শিশু রাসেলের প্রাণ কেড়ে নেয় ঘাতকের বুলেট। আগস্টের আগে প্রিয় হাসুপার সঙ্গে জার্মানি যাবার কথা ছিল। কিন্তু জন্ডিসে আক্রান্ত হবার কারণে যেতে পারেননি। সেদিন যদি তিনি জার্মানি যেতে পারতেন তাহলে হয়ত তাকে ঘাতকের বুলেট ভূপাতিত করতে পারত না।
ছোট্ট শিশুটি যে প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতম শিকার হয়েছিল, তা এখনও বিশ্বমানবতাকে বিচলিত করে। জন্মদিনে শেখ রাসেলকে স্মরণ করি গভীর আবেগ ও ভালোবাসায়।
লেখক: সাংবাদিক।