বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জন্মদিনের শ্রদ্ধা: উদয়ের আগে হারানো নক্ষত্র

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ১৮ অক্টোবর, ২০২১ ১৯:১১

রাসেল মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারতেন। আমরা একজন হৃদয়বান মানুষকে হারিয়েছি। যে শিশুর চোখে ছিল তারার আলো, ছিল অপার সম্ভাবনা, উদয়ের আগেই আমরা সেই নক্ষত্রকে হারিয়েছি। বাংলার পথেপ্রান্তরে কত ইতিহাস ছড়ানো। ক্ষমতার অলি-গলিতে কত যে ষড়যন্ত্র কত যে রক্তাক্ত ঘটনা!

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ৭ বছর। পিতার জন্য কাতরতা ছিল। পিতা পাকিস্তানের কারাগারে কিন্তু তার জেদ ছিল পিতার কাছে যাবে। স্বাধীন দেশে পিতা প্রধানমন্ত্রী, ব্যস্ততার শেষ নেই। এর মধ্যে রাসেল তার চিরসঙ্গী সাইকেলটি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এই সাইকেল ছিল পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই প্রিয়। যেটি এখনও তার স্মৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। পিতার একান্ত সান্নিধ্যে তার সময় কাটত কখনও কখনও। যদিও সেই মহান পিতাকে দেখার সুযোগ তার জীবনে খুবই কম ছিল।

শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করেন-

“টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে রাসেলের খেলাধুলার অনেক সাথি ছিল। বাড়ি গেলে গ্রামের ছোট অনেক বাচ্চা জড়ো করত। তাদের জন্য ডামি বন্দুক বানিয়ে দিয়েছিল। সেই বন্দুক হাতে তাদের প্যারেড করাত। প্রত্যেকের জন্য খাবার কিনে নিয়ে যেত। রাসেলের খুদে বাহিনীর জন্য জামা-কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে নিয়ে যাওয়া হতো। মাছ ধরা খুব পছন্দ করত। কিন্তু মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিত। রাসেল একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। মা ও আব্বার দেওয়া নাম রাসেল। স্কুলে নাম ছিল শেখ রিসাল উদ্দীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বারট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। রাসেলের বই পড়ে তিনি তার ছায়াসঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণুকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। এই দার্শনিকের কথা শুনে শুনে বঙ্গমাতা এতটাই বারট্রান্ড রাসেলের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে তার নাম অনুসারে নিজের ছোট ছেলে জন্মের পর তার নাম রাখলেন রাসেল।”

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণুর কনিষ্ঠ সন্তান। মুজিববর্ষে ২০২১ সালে শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয়ভাবে। ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করা শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধু পরিবারকে আবেগে-আহ্লাদে মাতিয়ে রাখতেন সবসময়। রাসেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। তবে তার বেড়ে ওঠার প্রথম অংশে ছিল রাজনৈতিক সংকটের কাল।

জন্ম থেকেই অনেক আলোকচিত্র সংরক্ষিত আছে শেখ রাসেলের। শেখ হাসিনার কোলে চড়ে এক কি দেড় বছরের রাসেল। মিষ্টি হাসিতে চেয়ে থাকা, পিতার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাসেল; তার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া অথবা খাবার টেবিলে বাবার ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা।

১৯৭৫-এ শেখ কামাল ও সুলতানা কামালের বৌভাতের দিন বঙ্গবন্ধু ও সুলতানা কামালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী বালক রাসেল। বঙ্গবন্ধুর কোলে কিংবা অন্য দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালসহ পিতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের যে ছবি আছে সেখানেও রাসেল বঙ্গবন্ধুর কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে পিতার স্নেহে ধন্য ছিলেন রাসেল; আলোকচিত্রগুলো সে সাক্ষ্য বহন করে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালের পর জেলের বাইরে থাকা পুরো সময়টাই রাসেলের সঙ্গে নিবিড় মমতায় জড়িয়েছিলেন। এমনকি স্বাধীনতার পর জাপান সফরে তিনি এই ছোটপুত্রকে সঙ্গী করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত রাসেলই ছিলেন তার আনন্দের সঙ্গী।

রাসেলের জন্মবার্ষিকীতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস শেখাতে পারলে রাসেলের হত্যাকারীদের বিপক্ষে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন-

“১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিল ছোট্ট রাসেলকে। বয়স তার মাত্র ১০ বছর ১১ মাস। মা-বাবা, দুই ভাই, দুই ভাবি, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে ঘাতকরা সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা তখন কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের রক্তাক্ত লাশ দেখে আকুল আবেদন জানায়, ‘আমার হাসুপার কাছে পাঠিয়ে দিন।’ এত মৃতদেহ দেখে যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসেখেলে বড় হয়েছিল কী কষ্টই না ও পেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকের পাষাণহৃদয় সে আকুতি শোনেনি। তারা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে শিশু শেখ রাসেলকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল ঘাতকরা?” এর উত্তর কে দেবে?

৩০ জুলাই ১৯৭৫, শেখ হাসিনা জার্মানিতে স্বামীর কর্মস্থলে চলে যান। রাসেল খুব মন খারাপ করে থাকতেন সেসময়। অসুস্থ থাকার কারণে শেখ হাসিনা রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি।

রাসেল মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারতেন। আমরা একজন হৃদয়বান মানুষকে হারিয়েছি। যে শিশুর চোখে ছিল তারার আলো, ছিল অপার সম্ভাবনা, উদয়ের আগেই আমরা সেই নক্ষত্রকে হারিয়েছি। বাংলার পথেপ্রান্তরে কত ইতিহাস ছড়ানো। ক্ষমতার অলি-গলিতে কত যে ষড়যন্ত্র কত যে রক্তাক্ত ঘটনা!

যে জাতি বিশ্বে বীরের জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, সে জাতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিশ্বজুড়ে মানুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা হারায়। বিদেশিরা মনে করত, যে বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে, সাহসী বাঙালি নিজেদেরকে একটি কাপুরুষ, আত্মঘাতী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে মানুষ তার সারা জীবনকে সঁপেছেন দেশের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, সে মানুষটাকে তো হত্যা করেছেই, তার পরিবারকেও ছাড় দেয়নি ঘাতকরা।

বঙ্গবন্ধুহত্যা মামলার বাদী পিএ মুহিতুল ইসলামের বর্ণনায়-

“ঘাতকদের অভিযানের শেষ শিকার ছিল শিশু রাসেল। সবাইকে হত্যার পর তাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। এ সময় রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চায়, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ঘাতক আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে রাসেলকে পুলিশ বক্সের ভেতরে আটকায়। এরপর দুই ঘাতক রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শুনতে পাই।”

আমরা একজন স্বর্ণসন্তানকে হারিয়েছি। আর যেন কোনো শিশুর ভাগ্যে এমন ঘটনা না ঘটে সেটাই আমাদের কাম্য। সেজন্য প্রত্যেক শিশুর জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য দেশ গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর অবদান, শেখ রাসেলের অনুভূতি ও শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডগুলো ছড়িয়ে দিতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

এ বিভাগের আরো খবর