শেখ রাসেল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোটভাই, যিনি ছিলেন বোনের নয়নের মণি। সেই নয়নের মণিকে পঁচাত্তরের কালরাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সদস্যদের এ হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ঘটনা। আজ বেঁচে থাকলে ৫৮ বছরে পা দিতেন শেখ রাসেল। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! নিষ্পাপ শিশুটিও রক্ষা পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। বেঁচে থাকলে হয়ত তিনিও বাবার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন, হতে পারতেন সেই অগ্রযাত্রার আরেক সৈনিক।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রাসেল যখন শহীদ হন, তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১১ বছর। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে তার জন্ম। ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ বইয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন-
“রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।”
বঙ্গবন্ধু চাইতেন তার সন্তান মুক্তমনা ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় মানুষ হয়ে উঠুক। ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন তার প্রিয় দার্শনিক। তাই আদরের সন্তানের নামকরণও করেন প্রিয় দার্শনিকের নামে। বঙ্গবন্ধু চাইতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের উদার, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক চেতনায় প্রভাবিত হোক শেখ রাসেল।
রাসেলের জন্মের বছরই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়। তিনি হাল ধরেন আওয়ামী লীগের। ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ গড়ে তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
১৯৬৪ সালে আবার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ভোটের ২ সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ফলে জন্মের পরের শৈশবে সেভাবে বাবাকে কাছে পাননি শেখ রাসেল।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কারাগারে বন্দি বাবাকে দেখতে গেলে তাকে রেখে ফিরে আসতে চাইতেন না। ফিরলেও মন খারাপ করে থাকতেন। এ নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে ১৯৬৬-এর ১৫ জুনের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম।
একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”
বাবা কাছে নেই। শিশু রাসেলের খেলার সঙ্গী প্রিয় সাইকেল আর কবুতর। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যটি অন্যান্য ভাই-বোনদের কনীনিকা। হাসি-আনন্দে সময় কাটালেও কী যেন একটা বিষাদের ছায়া বিরাজ করত ছোট্ট রাসেলের মনে, এটা হয়ত পিতাকে কাছে না পাওয়ার ব্যাকুলতা। এভাবেই একাকি বড় হয়ে উঠছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তখন রাসেলের বয়স ৪ বছর। ওই সময়টাতে শিশু রাসেল প্রথম পিতাকে তার কাছে পেলেন। পিতার সঙ্গেই দিনরাত কাটে তার। জেলখানার দিনগুলোর বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছোট ছেলে রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন-
‘‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’, ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’, ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।’ রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’’
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে বিরাজ করছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। এর মাঝে একাত্তরের ২৫ মার্চের কাল রাতে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কারাগারে।
মুক্তিযুদ্ধের ওই উত্তাল দিনগুলোতে মা ও বোনদের সঙ্গে শেখ রাসেলও বন্দি হয়েছিলেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে। বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল দেশমাতৃকার ডাকে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। রাসেল মা ও দুই বোনের সঙ্গে ঘরের ভিতর বন্দিজীবন কাটাতে থাকেন।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করার দিনও বন্দি ছিলেন তারা। বাইরে চলছে বিজয় উৎসব। ঘরের ভেতর থেকেই সেই উল্লাস শুনেছেন রাসেল। ১৭ ডিসেম্বর তারা বন্দিমুক্ত হলে রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধু তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। যিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন, নেতৃত্ব দিলেন সেই মহান নেতাকে ছাড়া বিজয় অর্জন যেন পূর্ণতা পাচ্ছিল না। বৈশ্বিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। সেখান থেকে যান লন্ডনে, এরপর দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফেরেন রাজনীতির মহানায়ক। পিতা দেশে ফিরলে শিশু রাসেলের মনে যেন আনন্দের বন্যা বইছে। বিস্ময়ভরা দুচোখে দেখেছেন।
বাবা দায়িত্ব নিলেন দেশ গড়ার। শিশু রাসেলও সবসময় বাবার সান্নিধ্য পেতে চাইতেন। যতক্ষণ বাবা আশপাশে থাকতেন, ততক্ষণ তার কাছাকাছিই থাকতে চাইতেন তিনি।
১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যস্ততার ওই সময়গুলোতেও পিতার সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন রাসেল। তখন তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।
বেবী মওদুদ তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন-
“রাসেল চঞ্চল প্রকৃতির হলেও কখনো কখনো হঠাৎ সে শান্ত হয়ে নির্জনে প্রিয়সঙ্গী সাইকেল নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করত। তার আরো প্রিয় সঙ্গী ছিল ভাগ্নে জয়। তার সঙ্গে খুনসুটিও করত, আবার জয় না হলে তার চকোলেট খাওয়া হত না, খেলা করা হত না। আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার উদারতায় রাসেল তার ক্লাসের বন্ধুদের খুব প্রিয় ছিল।”
আর পাঁচটি দিনের মতোই রাতের খাবার খেয়ে মায়ের হাতের মমতার স্পর্শে ঘুমাতে যান। ঘুমে আচ্ছন্ন রাসেল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় গুলির শব্দে। মা তাকে পেছনের দরজা দিয়ে কাজের লোকজনের সঙ্গে নিচে পাঠিয়ে দেন। চোখে তখনও ঘুম ঘুম ভাব, গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
ঘাতকরা তার হাত ধরে, অস্ত্র তাক করে রেখেছে। রাসেল কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব। আমি মায়ের কাছে যাব।’
ঘাতকেরা তার হাত ধরে বিভিন্ন কক্ষে নিয়ে গিয়ে বড়ভাই শেখ কামাল, চাচা শেখ আবু নাসের, স্নেহময় পিতা শেখ মুজিব, মমতাময়ী মা, ভাই শেখ জামাল, সদ্যপরিণীতা ভাবী সুলতানা ও রোজী– সবার রক্তাক্ত দেহ দেখাল। স্বজন হারানোর কষ্ট ছোট্ট রাসেলের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন রাসেল। আর বলছিলেন- ‘আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন!’
রাসেলের কান্নাজড়িত হৃদয়ের সে আকুতি শোনেনি ঘাতকেরা। তারা শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে। কাঁদতে কাঁদতে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে ছোট্ট শিশু রাসেল।
কিন্তু শিশু রাসেল হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় খুনি মুশতাক ও তার দোসররা। কালো আইন করে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করেন। খুনিদের রক্ষা করার কালো আইন বাতিল করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেন। এতে নিশ্চয়ই রাসেলের আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।