বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মন্দিরে কোরআন ও অনুভূতির করাত

  •    
  • ১৬ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:২৩

গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) যখন পবিত্র কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করলেন, তখন কেউ কি কোরআনের অবমাননা হয়েছে বলে অভিযোগে করেছিলেন? কেউ কি তখন এই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, একজন হিন্দু কেন কোরআন শরিফের অনুবাদ করবেন? কেউ কি তখন বলেছিলেন যে, যেহেতু একজন হিন্দু কোরআনের অনুবাদ করেছেন, অতএব কোনো মুসলমানের এই অনুবাদ পড়া উচিত নয়?

হিন্দুদের উপাসনালয় মন্দিরে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ থাকার কথা নয়। একইভাবে মুসলমানদের প্রার্থনালয় মসজিদেও হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গীতার প্রয়োজন হয় না। কারণ দুই ধর্মের প্রার্থনার পদ্ধতি ভিন্ন। সুতরাং কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন শরিফ অবমাননা করা হয়েছে বলে যে গুজব অথবা খবরের ভিত্তিতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল, সেখানে খতিয়ে দেখা দরকার, কে বা কারা মন্দিরে কোরআন রেখে এসেছেন। সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো লোক মন্দিরে কোরআন রেখে আসবেন আর এটাকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে— সাধারণ মানুষ এতটা অবিবেচক নয়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো লোক অবমাননার উদ্দেশ্যে ওই মন্দিরে কোরআন নিয়ে গেছেন— এটা ভাবার যেমন কোনো কারণ নেই, তেমনি কোনো সাধারণ মুসলমানও হিন্দুদের ওপর দোষ চাপিয়ে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর জন্য সেখানে কোরআন রেখে আসবেন— সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রশ্ন হলো- আসলেই মন্দিরে কোরআন ছিল কি না? থাকলে কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে সেখানে কোরআন রেখে এসেছেন? আর কেউ যদি সৎ বা অসৎ যেকোনো উদ্দেশ্যেই মন্দিরে কোরআন রেখে আসেন, তাতে কোরানের অবমাননা হয় কি না?

গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) যখন পবিত্র কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করলেন, তখন কেউ কি কোরআনের অবমাননা হয়েছে বলে অভিযোগে করেছিলেন? কেউ কি তখন এই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, একজন হিন্দু কেন কোরআন শরিফের অনুবাদ করবেন? কেউ কি তখন বলেছিলেন যে, যেহেতু একজন হিন্দু কোরআনের অনুবাদ করেছেন, অতএব কোনো মুসলমানের এই অনুবাদ পড়া উচিত নয়?

কোরআন শরিফ শুধু মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। সুতরাং কোনো মন্দিরের পুরোহিত বা পূজারি যদি মনে করেন যে, আন্তধর্মীয় সম্পর্ক বোঝানোর জন্য তারা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করবেন, সেজন্য কেউ যদি কোরআন শরিফ মন্দিরে নিয়ে যান, যদি এখানে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে সেটি কী করে অবমাননা হয়?

কোনো মসজিদের ইমাম যদি মনে করেন যে, তিনি হিন্দুদের কোনো দর্শন সম্পর্কে জানা বা বোঝার জন্য গীতা পড়বেন, এমনকি জুমার খুতবায়ও তিনি যদি মনে করেন যে, এটা থেকে রেফারেন্স দেবেন—তাতে কি গীতার অবমাননা হবে এবং এজন্য মসজিদে হামলা চালানো হবে? সব ধর্মের মূল বাণীই তো হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা। সুতরাং ধর্মগ্রন্থের অবমাননা হয়েছে— এই যুক্তিতে মানুষ কী করে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালায়? ধর্মীয় অনুভূতি এত ঠুনকো কেন?

কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা এবং এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেককে গ্রেপ্তারের পরে যে প্রশ্নটি বার বার সামনে আসছে তা হলো- ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা বা মানদণ্ড কী? অর্থাৎ কোন বক্তব্যে বা কী কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে?

মানুষের যদি বাকস্বাধীনতা থাকে; সংবিধান যদি নাগরিকের বাকস্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়— তাহলে সেই নাগরিকরা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কেন প্রকাশ্যে, উপাসনালয়ে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা ও বিতর্ক করতে পারবে না? আন্তধর্মীয় বিতর্কও হতে পারে। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই বিতর্ক প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতি বছরগুলোয় অবস্থা এমন হয়েছে যে, ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে কথা বললেই সেখানে অবমাননার গন্ধ খোঁজা হয়। এর ফলে অ্যাকাডেমিক আলোচনা বা বিতর্তের স্পেসও সংকুচিত হচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, লালমনিরহাটের পাটগ্রামে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা এবং তারপরে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এটি কোনো ধর্ম সমর্থন করে? যারা এই কাজ করেছেন, তারা যে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে এই কাজ করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই ইসলাম ধর্মের মহানবী মোহাম্মদ (সা.) সারা জীবনই সহনশীলতা ও ভিন্নমত প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে মক্কা থেকে তিনি কার্যত বিতাড়িত হয়েছেন— সেই মক্কা বিজয়ের পরে তিনি শত্রুদের প্রতিও যে মানবিক আচরণ করেছেন— সেটিই প্রকৃত ইসলাম।

অথচ কোরআন অবমাননা হয়েছে বলে একজন লোককে পিটিয়ে মারা হলো; মরদেহ পুড়িয়ে দেয়া হলো। মন্দিরে হামলা হলো। হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করা হলো। এর নাম ইসলাম নয়। বরং একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার পরে যে পুড়িয়ে দেয়া হলো, এটি স্পষ্টতই ইসলামের অবমাননা। কোনো মন্দিরে হামলা বা প্রতিমা ভাঙচুরই ইসলামের অবমাননা।

প্রশ্ন হলো, হাজার হাজার মানুষ এই যে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের অবমাননা হয়েছে গুজবে একটি জায়গায় জড়ো হলেন এবং একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার পরে পুড়িয়ে দিলেন; এই যে কিছু লোক জড়ো হয়ে কুমিল্লার মন্দিরে হামলা চালালেন, এর পেছনে কোন মন্ত্রটি কাজ করে? মানুষ কেন ‘ধর্মের অবমাননা’ হয়েছে শুনলেই উত্তেজিত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং হত্যার মতো জঘন্য কাজে শামিল হয়? ধর্মীয় শিক্ষার কোথাও কি তাহলে একটা বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে? ধর্মের উদ্দেশ্যই যেখানে মানুষকে আরও বেশি মানবিক ও সহনশীল করা, সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ শুনলেই মানুষ কেন হিংস্র হয়ে ওঠে?

বাস্তবতা হলো- অধিকাংশ মানুষই ব্যক্তিজীবনে ধর্মের অনুশাসনগুলো ঠিকমতো পালন না করলেও নিজধর্মের কোনো বিষয়ে ভিন্নমত শুনলেই তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যে মানুষটি নিজে অন্যায় করে, ঘুষ খায়, মানুষ ঠকায়, মিথ্যা বলে— অথচ কেউ যখন কোনো ধর্মীয় নেতা বা ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে, তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করে।

মুরতাদ ঘোষণা করে ফাঁসির দাবি জানায়। অথচ ব্যক্তিজীবনে সে নিজেই ধর্মকর্মের ধারেকাছে নেই। এখানে ধর্মীয় অনুভূতি কোনো বিষয় নয়। এখানে বিষয়ের আড়ালে অন্য বিষয় রয়েছে। সেই বিষয়ের অনুসন্ধান জরুরি।

একটি বড় কারণ আমাদের ভোটের রাজনীতি। কেননা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে এই ধর্ম বরাবরই অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। প্রধান দলগুলোও ধর্মকে ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যেহেতু এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এবং এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের চর্চা না করলেও এবং সারা জীবন মিথ্যা ও দুর্নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও নিজের ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থের কথিত অবমাননার খবর পেলেই লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে; ফলে রাজনীতিবিদরাও জানেন মানুষের এই হুজুগকে ভোটের মাঠেও কাজে লাগানো সম্ভব। যে কারণে আমাদের শীর্ষ রাজনীতিবিদরাও নিজেদেরকে যতটা ‘মানুষ’ তার চেয়ে বেশি ধার্মিক হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত থাকেন। সাধারণ নেতাকর্মীরাও তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের কে কত বড় ধার্মিক; ধর্মীয় বিষয়ে তাদের কার কী অবদান; কে কতগুলো উপাসনালয় বানিয়েছেন— সেই তথ্য গর্বভরে প্রচার করা হয়।

অথচ শীর্ষ রাজনীতিবিদদের উচিত, ধর্ম নিয়ে যতটা সম্ভব কম কথা বলা। কিন্তু তারা কম কথা বলেন না। কারণ ধর্ম তাদের কাছে ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় নয়। তারা জানেন, ধর্ম এই দেশে বিরাট রাজনৈতিক অস্ত্র— যে অস্ত্র ভোটের বৈতরণি পার হতে সহায়তা করে। অতএব কুমিল্লার ঘটনার পেছনে যে সাধারণ মুসলমান বা হিন্দুর প্ররোচনা নেই, বরং এটি যে কোনো অসৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক গেমের অংশ— তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। তবে এই রাজনীতি খুঁজতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে রাজনীতি না করে; যাতে প্রকৃত অপরাধীরাই ধরা পড়ে— সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর