বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বেদনাবিধুর জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি

  • নিরঞ্জন রায়   
  • ১৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৫:৪৬

রোকেয়া হলের ছাত্রী অর্চনা সাহা যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা সত্যি মনে রাখার মতো। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এক মেধাবী ছাত্র শান্তিপ্রিয় চাকমা রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ছাত্রদের সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে এতটাই বিমর্ষ, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন যে, একদিন দুপুরে জগন্নাথ হলের উত্তর ভবনের নিজকক্ষে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।

১৫ অক্টোবর বেদনাবিধুর একটি দিন। ১৯৮৫ সালের এই দিনটির দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অডিটোরিয়াম ভবনের ছাদ ধসে ৩৯ ছাত্র নিহত এবং ৩ শতাধিক আহত হয়। বিশ্বের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনায় এত সংখ্যক শিক্ষার্থী হতাহতের ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না জানা নেই। তবে আর যেন কখনই কোথাও না ঘটে, সেটাই কামনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে অল্পের জন্য সে দুর্ঘটনা থেকে যেভাবে নিজে রক্ষা পাই এবং যেভাবে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করি তা এত বছর পরেও বিস্মৃত হইনি, মনে পড়লেই শিউরে ওঠি। সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্গাপূজার ছুটি শুরু হয় এবং পরদিন অধিকাংশ ছাত্রের পূজা উপলক্ষে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। তখন টেলিভিশনে একটি জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ প্রচারিত হচ্ছিল। ছাত্ররা নাটকটি দেখার জন্য অডিটোরিয়াম ভবনে সমবেত হয়। যদিও তখন সেই ভবনের ছাদ মেরামতের কাজ চলছিল। আমি নিজেও আমার এলাকার অগ্রজ অশোক সাহা এবং সহপাঠী গৌতম মল্লিকের সঙ্গে অডিটোরিয়ামে টেলিভিশন সেটের কাছাকাছি বসে ছিলাম।

খবর শুরু হতেই ভাবলাম যে, নাটক শেষে খাবার খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই অশোক দা এবং বন্ধু গৌতমকে সিট রাখার কথা বলে রাতের খাবার শেষ করার জন্য বেরিয়ে যাই। আর এতেই অল্পের জন্য সেই দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাই। পরে অশোক দাকে খুঁজে পাই হলের শহীদমিনারের পাদদেশে রাখা লাশের সারিতে, আর বন্ধু গৌতমকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালের বিছানায়।

এর দুদিন আগেই অশোক দার সঙ্গে পরিচয়। যথেষ্ট উৎফুল্ল ছিলেন কারণ সরকারি কর্মকর্তা পদে চাকরি হয় তার। আমাকে অনেক উপদেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সাধের নিয়োগপত্র হাতে আসার আগেই হয়ে গেলেন লাশ!

সেসময় হলে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ ছিল নিয়মিত ঘটনা। কদিন ধরেই সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠন- নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের হল আক্রমণের গুজব চলছিল। আমরা যখন হলের ডাইনিং রুমে খাবারের মাঝপথে, তখন হঠাৎ দমকা বাতাসের সঙ্গে এক বিকট শব্দ পাই, সেই সঙ্গে কিছু মানুষের চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ। আমরা ধরে নেই যে, নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ হল আক্রমণ করেছে। নিজেদের রক্ষা করার জন্য খাবার ফেলেই হলের পুকুরপাড়ের কর্মচারীদের বাসার দিকে দৌড়ে পালাতে শুরু করি। কিছু দূর যেতেই আমাদের ভুল ভাঙে। এটা ছাত্র সংগঠনের আক্রমণ নয়, হলের অডিটোরিয়ামের ছাদ ধসে পড়েছে।

তখনই ছুটে যাই অডিটোরিয়ামের সামনে। শুধু অডিটোরিয়ামের ভিতর থেকে আসা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাই। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে অডিটোরিয়াম থেকে আহতদের উদ্ধার করার কোনো সুযোগ ছিল না। শুধু দরজার সামনে দাঁড়ানো যেসব ছাত্র আঘাত পেয়ে আহত হয়ে ছিটকে পড়েছিল তাদের নিয়েই হাসপাতালে যেতে পেরেছিলাম।

বিপুলসংখ্যক আহত ছাত্রের সেবা দেয়ার জন্য হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে প্রথমদিকে কিছুটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেও, মুহূর্তের মধ্যে ডাক্তার নার্স ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে আহত ছাত্রদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করে। রাত বাড়ার সঙ্গে উদ্ধার কাজেও গতি পায় এবং সে সঙ্গে হলের শহীদমিনার প্রাঙ্গণে রাখা লাশের সারিও বাড়তে থাকে।

মাঝরাতের মধ্যেই পঁচিশ ছাত্রের লাশ রাখা হয় শহীদমিনারের পাদদেশে। অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত ছিল যে, লাশের সারি থেকে একজন ছাত্রের দেহ নড়েচড়ে ওঠে এবং বেঁচে থাকার আকুতি জানায়। মুহূর্তের মধ্যে তাকে আবার হাসপাতালে নেয়া হয়, যদিও বাঁচানো যায়নি। কারণ, হাসপাতালে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। সকাল হতেই উদ্ধারকাজ শেষ হয় এবং তখন পর্যন্ত ৩৫ ছাত্রের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। পরে আরও কজন আহত ছাত্র হাসপাতালে মারা যায়। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আহতদের সহযোগিতা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন মহল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

এই দুর্ঘটনার পর সেদিন জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এমনকি পুরো ঢাকা শহরে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা আবারও প্রমাণ করে যে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ বাংলদেশ যে সত্যিকার অর্থে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ তাও প্রমাণিত হয় সেদিন।

যে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে ছাত্রদের ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা নিত্যদিনের ঘটনা, সেই রিকশাওয়ালারাও আগ্রহভরে বিনা ভাড়ায় আহত ছাত্রদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তদানের জন্য আহবান জানানোর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ছাত্রজনতা রক্তদানের জন্য এগিয়ে আসে। দুর্ঘটনার পরদিন আবহাওয়া মোটেই অনুকূল ছিল না। দিনভর বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে বৃষ্টিতে ভিজে ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ জগ্ননাথ হলের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে শুধু নিহত ছাত্রদের এক পলক দেখার জন্য। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।

জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্র ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় প্রাইভেট পড়াত। তাদের অভিভাবকরাও ছুটে আসে ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষকের খোঁজখবর নিতে। অনেকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

তখন মোবাইল ফোন ছিল না। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে আসা ঢাকা শহরের বাসিন্দারা হলে যাদের পেয়েছে, তাদের কাছেই ঠিকানা দিয়ে বলে যোগাযোগ করার জন্য, যেন তারা কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে। আমার কাছেও কজন অভিভাবক তাদের বাসার ঠিকানা রেখে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।

আমি প্রথমবর্ষের ছাত্র ছিলাম এবং ঢাকায় নতুন তখন। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তেমন কিছু করতে পারিনি। শুধু হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি এবং হলের বিভিন্ন ভবন ও শহীদমিনার পর্যন্ত ছোটাছুটির মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রাখি। কিন্তু আমার গ্রামের বাড়ির অবস্থা কী হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো ধারণাও ছিল না। আমার গ্রামের এক অগ্রজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলের ছাত্র আমজাদ ভাই দুপুরের দিকে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। জোরপূর্বক বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বাড়ি পৌঁছে দেখি সেখানে আরেক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়ে আছে।

যেহেতু আমার নামের একাধিক ছাত্র নিহত হয় এবং রেডিও টেলিভিশনে সে খবর প্রচারিত হয়; তাই গ্রামের মানুষ ধরে নেয় যে, আমিও দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছি। গ্রামের অসংখ্য মানুষ আমাদের বাড়িতে সমবেত হয় বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। দেখার পর বাড়ির লোকজন এবং গ্রামবাসী যেন আমাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল।

শিক্ষা খাতে চরম অবহেলা এবং উদাসীনতার শিকার হয়েই এই ৩৯ মেধাবী ছাত্র অকালে প্রাণ হারায়। কিন্তু দুর্ঘটনা-পরবর্তী সব স্তরের মানুষের সহমর্মিতা, সাহায্য-সহযোগিতা এবং গৃহীত ব্যবস্থা অবশ্যই সান্ত্বনা জোগায়। সেসময় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ললিত মোহন নাথ, অন্যান্য হাউজ টিউটর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা নিশ্চিত করেন। ইংরেজির অধাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে আহত ছাত্রদের সেবা-শুশ্রূষার ব্যবস্থা নেন।

রোকেয়া হলের ছাত্রী অর্চনা সাহা যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা সত্যি মনে রাখার মতো। হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এক মেধাবী ছাত্র শান্তিপ্রিয় চাকমা রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ছাত্রদের সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে এতটাই বিমর্ষ, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন যে, একদিন দুপুরে জগন্নাথ হলের উত্তর ভবনের নিজকক্ষে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার মাস খানেক পর জগন্নাথ হলের মাঠে ইংরেজির প্রফেসর এবং সেসময়ের হাউজ টিউটর কাশিনাথ বসাকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় আগত অনেক নিহত ছাত্রের মায়ের আহাজারিতে আকাশ বাতাস যেভাবে ভারী হয়ে ওঠে তা ভেবে আজও চোখের জল আটকাতে পারি না।

সে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পঁয়ত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এতে যারা আহত হয়েও বেঁচে ছিল তাদের অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যারা দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে নিতে ভালো ভূমিকা রাখে তাদেরও অনেকে গত হয়েছে। চলে গেছেন সেসময়ের প্রাধ্যক্ষ ললিত মোহন নাথ এবং ইংরেজির অধ্যাপক ও হাউজ টিউটর কাশীনাথ বসাক। সেসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান এরশাদও চলে গেছেন। যার অনুপ্রেরণায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলাম এবং সুস্থ আছি কি না সে চিন্তায় যিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, আমার সেই অগ্রজ আমজাদ ভাইও অকালে চলে গেছেন গতবছর।

সে ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। অক্টোবর স্মৃতি ভবন তারই একটি কক্ষে থেকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করি। হলের ঝুঁকিপূর্ণ আগের ভবন কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হবার আগেই সরিয়ে ফেলে নতুন একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর এই দিনটি বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। আর আমাদের স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যায়নি সেই বিভীষিকাময় রাত্রির বেদনাময় ঘটনা।

লেখক: কলাম লেখক, ব্যাংকার। কানাডা-প্রবাসী।

এ বিভাগের আরো খবর