বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিষণ্ন বিজয়া দশমী

  • দুলাল আচার্য   
  • ১৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:৫৬

পূজায় এবার দেশের কয়েকটি স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় মন্দিরে হনুমানের কোলে পবিত্র কোরআন শরীফ পাওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার ঘটনা শান্তিপ্রিয় মানুষকে বিস্মিত করেছে! এটা আমাদের সম্প্রীতির বাংলাদেশের চিত্র নয়। এটা নিঃসন্দেহে ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ন্যক্কারজনক কাজ।

প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবের। আজ বিজয়া দশমী, অশ্রুসজল নয়নে ভক্তরা দুর্গতিনাশিনী দেবীদুর্গাকে বিদায় জানাবে। সনাতন ধর্মমতে, আজ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে। মহালয়ার মধ্য দিয়ে যে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছিল বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটছে। এই ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই জগৎজননী প্রকৃতি ও মানবকুলকে আলোকিত করে যাবেন। আগামী শরতে মা আবার ফিরে আসবেন- এমন প্রত্যাশা নিয়েই তাকে বিদায় জানাবে ভক্তরা।

শরৎকাল মানেই দেবীদুর্গার আগমনীবার্তা। প্রতিবারের মতো দেবীবরণে এবারও প্রস্তুত ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। অসুর নাশকারী দেবীর পৃথিবীস্পর্শে পূর্ণতা পায় ঋতুরাণী শরৎ। দেবীর সন্তুষ্টি লাভে পাঁচ দিনব্যাপী পূজা-অর্চনায় মেতে ছিল সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন। উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বিশ্বব্যাপী নির্মল সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত উৎসবের ফল্গুধারা বইছে।

সাড়ম্বরে এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও কল্যাণময় অবস্থানের বিকাশ আরও বিস্মৃত এবং বিকশিত হয়। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মঙ্গলদায়ক, শুভশক্তি ও ইতিবাচক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটে। সামাজিক সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখে।

হিন্দু ধর্মে দেবীদুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্যরূপ। দেবী দুর্গার পুরো কাঠামোতে থাকে ৮টি মূর্তি। এটি তার সংহতি শক্তি বা সব শক্তির ভিন্নভাবে দেখানো এক রূপের স্থিতি। যেমন গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তার এক অঙ্গে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। তেমনি সর্বশক্তিমান মায়েরও সেইরূপ এক কাঠামোতে পরিস্ফুটন করা হয়েছে।

প্রতিটি জাতি-দেশ, রাষ্ট্র চারটি শক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় এবং প্রসার ও স্থিতি লাভ করে। এই শক্তিগুলো হচ্ছে জ্ঞান, ক্ষেত্র, ধন ও জনশক্তি। গীতায় বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণরূপে। মূলত এ ভাগ কোনো ভেদ বা পৃথকীকরণ নয়, একের মধ্যেই যে এ চারের অবস্থান তা দেখানো হয়েছে। দেবী দুর্গা কাঠামোতে জাতি ভেদ নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে একই দেহে চারগুণের অবস্থান ও শক্তি। কাঠামোতে প্রধান রূপ মায়ের। মা দুর্গার আধ্যাত্মিক রূপ হলো দুঃখ। তবে দুর্গতিনাশিনী সর্বকল্যাণ কাম্য দশভুজা মা এক কিন্তু অনন্ত অসীম।

ভক্তকুলের শেষ আশ্রয় মা দুর্গা। সুখে-দুঃখে সব কিছুতেই মা, তাই তার রূপ মাতৃরূপ। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, মায়ের ওপর সন্তানের জোর বেশি খাটে, তাই মাতৃরূপে তার আরাধনাই হিন্দুদের কাছে অধিক প্রাধান্য। একারণে মায়ের দশ হাত সর্বব্যাপিত্বের প্রতিনিধি। সন্তানের কল্যাণ কামনায় সব সময় মন্দের সঙ্গে মা যুদ্ধরত।

এখানে মন্দের রূপ অসুরের সঙ্গে মায়ের শক্তি আলাদা করে বর্ণনায় দেখা যায়। ১. শ্রীশ্রী লক্ষ্মী ধনশক্তি মা- জগৎ পালিনা মা বিষ্ণু শক্তি ২. শ্রীশ্রী সরস্বতী- মায়ের জ্ঞানের বা সাত্ত্বিকতার প্রতীক ৩. শ্রীশ্রী গণেশ-গণদেবতা বা জনশক্তির রূপ, শূদ্র বর্ণ ৪. শ্রীশ্রী কার্তিক- মায়ের ক্ষাত্রশক্তি পরাক্রমশালী চির তারুণ্য যুবশক্তি ৫. সিংহ- হিংস্রতা, পশুত্ব এবং রজ’র প্রতীক ৬. অসুর- অহংকার, কাম ও তমদোষের প্রতীক।

আসলে সকল শক্তির আধার মা। তাই অশুভ (অসুর) শক্তিকে মা রেখেছেন পদতলে অর্থাৎ জগতে কোনো ভালো কাজ করতে হলে মাকে যেমন প্রয়োজন দৈব ও কল্যাণ শক্তিরূপে, তেমনি প্রয়োজন ইষ্টলাভের জন্য হিংস্র পশুশক্তি ও অশুভ (কাম) ক্রোধ দম্ভ দর্প অজ্ঞানতাকে পদদলিত করতে।

দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো- ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’। সব অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্য পৃথিবীতে প্রতি বছর দুবার দেবীদুর্গার আগমন হয়। প্রাচীনকাল থেকে বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী নামে পৃথিবীতে মা দুর্গা আবির্ভূত হন যা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। এটা দুর্গার আরেক রূপ। শরৎকালে শারদীয়া নামে। দুই পর্বেই অসুরের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেন দুর্গতিনাশিনী। সেই থেকে বিজয় ঘটে শুভশক্তির।

দেবীর আগমন ঘটে অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে সজ্জনদের প্রতিপালনের অঙ্গীকার নিয়ে, মানুষের মধ্যে নৈতিক আদর্শ জাগ্রত করার জন্য। মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দৈন্য ও কলুষতা দূর করার জন্য। এজন্য দুর্গোৎসব ধর্মীয় উৎসব হলেও তা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সম্প্রদায়গত বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে এক পরম আনন্দের সোপানে দাঁড় করাচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব সবার জন্য থাকে উন্মুক্ত। দেবীদুর্গার আগমনী আনন্দকে সবাই ভাগাভাগি করে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতি নিরন্তর উন্মুক্ত উৎসবমুখর পথে চলতে পছন্দ করে। এই পছন্দের স্রোতধারায় এই কদিন ভিন্ন আমেজ ও ভিন্নতর সুবাতাস বয়ে গেছে দেশজুড়ে।

দেবীদুর্গা সাধারণত গজ, ঘোটক, নৌকা এবং দোলা এই চার প্রকার বাহনেই আগমন এবং গমন করেন। ২০২১ সালে দেবীর আগমন হয়েছে ঘোটকে। আর কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন দোলায়। শাস্ত্রমতে, এবারের আগমন এবং গমন উভয়ই অশুভ ইঙ্গিত। দোলা অর্থাৎ পালকিতে আগমন বা গমনের ফল- দোলায়াং মকরং ভবেৎ অর্থাৎ মহামারি বা মড়কতুল্য বিষয়ে ভোগার আশঙ্কা। ঘোটক অর্থাৎ ঘোড়া। ঘোড়ায় আগমন বা গমনের ফল ছত্রভঙ্গ, ধ্বংস বা ছন্নছাড়া কিংবা ধ্বংসাত্মক লীলার আশঙ্কা।

এক্ষেত্রে মা দুর্গাই রক্ষাকর্তা। মা তার ভক্তের কল্যাণে সর্বদাই নজর রাখেন। বাংলাদেশ বরাবরই ধর্মীয় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন। সবাই স্বাধীনভাবে নিজধর্ম পালন করছে। ধর্ম যার যার উৎসব সবার- এদেশের মানুষের এই অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার পূজাকে সীমিত আকারে করা হলেও আনন্দঘন আবহের সৃষ্টিতে কোথাও কমতি ছিল না।

পূজায় এবার দেশের কয়েকটি স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লায় মন্দিরে হনুমানের কোলে পবিত্র কোরআন শরীফ পাওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার ঘটনা শান্তিপ্রিয় মানুষকে বিস্মিত করেছে! এটা আমাদের সম্প্রীতির বাংলাদেশের চিত্র নয়। এটা নিঃসন্দেহে ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ন্যক্কারজনক কাজ। এদেশে এই ধরনের ঘটনা সত্যি দুঃখজনক। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনা ঘটেছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো অপশক্তি তাদের হীন উদ্দেশ্যে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে, এটি তারই অংশ।

এ বিষয়ে কজন সন্দেহভাজন আটক হয়েছে। তদন্ত ও অনুসন্ধান চলছে। আমাদের বিশ্বাস প্রকৃত তথ্য প্রকাশ ও অপরাধী শনাক্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

অবশ্য সামাজিক সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখে। মায়ের কাছে প্রার্থনা কলুষমুক্ত সমাজ, সুন্দর দেশ ও সুস্থ পৃথিবী গড়া। মানব-ধরা আজ মহামারি করোনা নামক অপশক্তির কোপানলে। বলা যায়, বিশ্ব এখন মহাসংকটের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। এই সংকটে জগৎমাতা দেবীদুর্গার সুদৃষ্টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। মায়ের আশীর্বাদ পর্যবসিত হোক বসুন্ধরায়। দূর হোক অন্ধকার, ছড়িয়ে পড়ুক আলো। মানুষের মাঝে উদয় হোক শুভবুদ্ধি। বিরাজ করুক শান্তির সুবাতাস।

করোনামুক্ত পৃথিবী মায়ের কাছে এই মুহূর্তের প্রার্থনা। মা তার ভক্তকুলকে সব অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন অতীতের মতো। ধর্ম মানুষে মানুষে প্রীতি, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ঐক্য ও শান্তির ডাক দিয়ে যায়। তারপরও অসুরের আকস্মিক উন্মত্ততা নষ্ট করে দেয় আবহমানকালের প্রীতিধন্য পারস্পরিক অবস্থানকে, ধ্বংস করে দেয় দীর্ঘকালের হৃদ্যতা। সৃষ্টি হয় বৈষম্য, বিভেদ, হিংসা, অন্যায় ও অকল্যাণ। আর এজন্যই মঙ্গলদাত্রী দেবীদুর্গার আগমন ঘটে কল্যাণ ও শান্তিকে সংস্থাপন করার জন্য।

বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন থাকবে, দূর হবে সব সংকীর্ণতা ও বিভেদ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি রক্ষা হবে, এমন প্রার্থনাই আনন্দময়ীর কাছে।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর