ফেসবুকে নানা অ্যাকাউন্ট আর গ্রুপে শেয়ারবাজার নিয়ে নানারকম তথ্য শেয়ার করা হয়। নামধারী বিশেষজ্ঞরা তাদের অনুসারীদের ‘মানি ডাবল’ আইটেম দেন। অনেকে আবার ইনবক্সে আসার পরামর্শ দেন। বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য তাদেরকে লাভের অংশও দিতে হয়। তেমনি এক সাধারণ বিনিয়োগকারী নামধারী এক বিশেষজ্ঞের কাছে ‘মানি ডাবল’ আইটেম চাইলেন।
এমনিতে গত কদিন ধরে মূল্য সংশোধন চলছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা একটু আতঙ্কিতও। ‘মানি ডাবল’ আইটেম চাওয়া সেই বিনিয়োগকারীর স্ট্যাটাসে আরেক রসিক বিনিয়োগকারী মন্তব্য করলেন, শেয়ার না কিনে পেঁয়াজ কিনুন, ডাবল হবে। সেই বিনিয়োগকারী যদি সত্যি সত্যি শেয়ার না কিনে পেঁয়াজ কিনতেন, তাহলে একমাসে তার মানি ডাবল হয়ে যেত। শেয়ারবাজারে মূল্য সংশোধন হলেও নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় বেসামাল সাধারণ মানুষ।
অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। তবে মৌলিকতম চাহিদা হলো- অন্ন। মানুষ গাছের পাতা পরে, গাছতলায় থেকেও জীবনধারণ করতে পারে। কিন্তু না খেয়ে বাঁচতে পারে না। এখন এই খাবার কিনতেই মানুষের ফতুর হওয়ার দশা।
শায়েস্তা খাঁর আমলে ঢাকায় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। শুনলে রূপকথা মনে হতে পারে। কিন্তু বুঝতে হবে, তখন মানুষের আয়ও কম ছিল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের আয় বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে ব্যয়ও। মূদ্রাস্ফীতির সঙ্গে ঘটে মূল্যস্ফীতিও। সমস্যা হলো- যখন ব্যয়ের সঙ্গে আয় পাল্লা দিতে পারে না। গত দেড় বছরে করোনার হানায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই বড় ধাক্কা খেয়েছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।
বরং স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা বাংলাদেশে ধাক্কাটা বেশিই লেগেছে। শুরুতে ভেবেছিলাম, করোনার ধাক্কা সবার গায়েই লাগবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- যথারীতি করোনার মূল ধাক্কা লেগেছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তের গায়েই। উচ্চবিত্তের মানুষের গায়ে করোনার আঁচ তেমন লাগেনি। করোনা মানুষের জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে।
গত দেড়বছর, বিশেষ করে প্রথম একবছর সবকিছুই ছিল অনিশ্চিত। কত মানুষ চাকরি হারিয়েছে, কত মানুষের ব্যবসা লাটে উঠেছে, কত মানুষ পেশা পরিবর্তন করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অনেক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে গেছে, এর সংখ্যা কোনো পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না। এই সময়টা ছিল মানুষের টিকে থাকার, কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকা আর কি। কিন্তু এই বেঁচে থাকার সংগ্রামটা আরও কঠিন করে দিয়েছে বাজারদর।
বলছিলাম আয়-ব্যয়ের হিসাবের কথা। আগেও বলেছি, করোনার সময়ে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে আরেকটা চাকরি জোগার করে ফেলা কঠিনই শুধু নয়, অসম্ভবও। তাই আগের দিনও ছিলেন সচ্ছল মধ্যবিত্ত, পরদিন তিনি এক ধাক্কায় নিম্নবিত্ত অথবা নিঃস্ব। যাদের চাকরি যায়নি তাদেরও বেতন বাড়ে তো নাই-ই, অনেক অফিস বেতন কমিয়ে দিয়েছে।
এমনিতে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট হওয়ার কথা। সরকারি অফিসে নিয়ম করে ইনক্রিমেন্ট হলেও সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই নিয়ম মানে না। ইনক্রিমেন্টকে আমি কখনও বেতন বাড়ানো বলি না। ইনক্রিমেন্টে আসলে মূদ্রাস্ফীতি সমন্বয় হয়ে যায়। তাই ইনক্রিমেন্ট না হওয়া মানে মূদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় বেতন কমে যাওয়া। চাকরি হারানো, পেশা বদলানো, বেতন কমে যাওয়ার ধাক্কায় মানুষ যখন দিশেহারা; তখন বাজারদর তাদের অসহনীয় বোঝার ওপর শাকের আটি চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মানুষের এখন আর শাকের আটি নেয়ারও সামর্থ্য নেই।
বাজারে যখন আগুন লাগে, তখন মুক্তবাজার অর্থনীতি, চাহিদা-সরবরাহতত্ত্ব হাজির করা হয়। কিন্তু অর্থনীতির এই জটিলতত্ত্বে তো মানুষের পেট ভরবে না। এতকিছু তারা বুঝবেও না। সাধারণ মানুষ তাদের আয় অনুযায়ী ব্যয় করে খাবার কিনতে চাইবে। যখন পারবে না, তখন তাদের খাবারটা কে দেবে?
বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন এবং চিনির দাম বাড়ছে। তাই বাংলাদেশেও এই পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যে চালের দাম কমছে, তাহলে চালের দাম কমছে না কেন? বাংলাদেশের বাজার ব্যবসায়ীদের নানা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এখানে আন্তর্জাতিক বাজার বা কোনো জটিল তত্ত্ব খাটে না। এখানে ব্যবসায়ীদের একটাই তত্ত্ব- লাভ। আর তাদের এই লাভের লোভের আগুনে পুড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই লাভ করবে। কিন্তু লাভেরও তো একটা ন্যায্যতা থাকবে।
ভারতের কোনো এক রাজ্যে বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের টেকনাফে পেঁয়াজের দাম সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে কেন? ভারতে বৃষ্টি হলে সেখানকার বাজারে এর প্রভাব পড়বে, সেই পেঁয়াজ বেনাপোল বা ভোমরা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। তারপর সেখান থেকে ঢাকা হয়ে টেকনাফ যাবে। কিন্তু টেকনাফের যে ব্যবসায়ী দ্বিগুণ দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন, সেটা তো আগের দামে কেনা। সেই ব্যবসায়ী কিন্তু ফাঁকতালে শেয়ার বাজারের সেই বিনিয়োগকারীর মতো ‘মানি ডাবল’ আইটেম পেয়ে যান। তার চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে এখনও পেঁয়াজের যা স্টক আছে, তাতে দুই মাস চলার কথা। তাহলে তো ভারতের বৃষ্টির প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দুই মাস পরে পড়ার কথা। পেঁয়াজের ৮০ ভাগই এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ২০ ভাগ আসে ভারত থেকে। গত কয়েকবছর ধরে সেই ২০ ভাগ ৮০ ভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা অর্থনীতির কোন সূত্র?
ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। অথচ এটা করার কথা সরকারের, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সরকার গর্ব করে বলে, তারা ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার। সমস্যাটা এখানেই, সরকার আসলে ব্যবসায়ীবান্ধব নয়, ব্যবসায়ী-নিয়ন্ত্রিত। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যার কাজ সেই বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও একজন ব্যবসায়ী। সম্ভবত তারা নানা উদ্যোগে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হন।
সরকার যেদিন ব্যবসায়ীবান্ধব থেকে জনবান্ধব হতে পারবে; সেদিন সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে বাজারে যেতে পারবে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকার জনগণের ভালোমন্দ দেখভাল করবে। প্রয়োজনে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে। চাহিদা ও সরবরাহনীতিই যদি বাজারকে মুক্ত করে দেয়, তাহলে আর সরকারের দরকারটা কী? সরকার কখনও শুল্ক বাড়িয়ে, কখনও কমিয়ে বাজারকে জনগণের জন্য সহনীয় রাখবে। ধরুন, যখন দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে, তখন কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, তাই শুল্ক বাড়িয়ে দেবে। আর যখন দেশের বাজারে সংকট সৃষ্টি হবে, তখন শুল্ক প্রত্যাহার করবে। এটাই সরকারের দায়িত্ব।
গত কবছর ধরেই একটা সময়ে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়। কল্যাণ রাষ্ট্র হলে পেঁয়াজের বাজারের ক্যালেন্ডার আমার আপনার মনে রাখলেও চলবে। আর বাণ্যিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজই এটা। কিন্তু সমস্যা হলো- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সবার আগে এই ক্যালেন্ডার ভুলে যায়। পেঁয়াজ ‘মানি ডাবল’ আইটেম হয়ে গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘুম ভাঙে। তারা তখন শুল্ক কমানোর জন্য প্রস্তাব। লালফিতা পেরিয়ে এই প্রস্তাব পাস হতে হতে ব্যবসায়ীদের ‘মানি ডাবল’ হয়ে যায়, সাধারণ মানুষের কাছে পেঁয়াজ মহার্ঘ্য হয়ে যায়। এটা শুধু পেঁয়াজ নয়, সব পণ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি। সিদ্ধান্ত নিতে নিতে সরকারের শুধু দেরিই হয়ে যায়।
সরকার ব্যবসায়ী নয়। তারা লাভের চিন্তা করবে না। তারা মানুষের জীবনকে সহনীয় করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। সরকার কৃষিতে, জ্বালানি তেলে, বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়। প্রয়োজনে বাজারেও দিতে হবে। করোনার সময় সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে, সেই প্রণোদনার ছিটেফোঁটাও জনগণ পায়নি। এবার সরকার শক্ত হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করুক, জনগণের পাশে দাঁড়াক। যদি কোনো ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, যদি ভোমরা বন্দরের পেঁয়াজ ঢাকায় আসতে আসতে আকাশ ছোঁয়; তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাজারে আগুন লাগলে টিসিবি ট্রাকে করে ন্যায্য দামে নিত্যপণ্য বিক্রি করে। সাধারণত নিম্নবিত্তের মানুষ এখান থেকে পণ্য কিনত। মধ্যবিত্তের পেটে ক্ষুধা, চোখে লাজ। তাই দরকার থাকলেও তারা ট্রাকের লাইনে দাঁড়াবে না। কিন্তু করোনা এসে তাদের চোখের লজ্জার সেই পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে। শুরুর দিকে একটু আড়াল করে লাইনে দাঁড়ালেও এখন অধুনা নিম্নবিত্ত সাবেক মধ্যবিত্তরাও অনায়াসে লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সরকার অন্তত টিসিবির ট্রাক ছড়িয়ে দিক সারা দেশে। মানুষ অন্তত খেয়ে বাঁচুক।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক।