বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাষ্ট্র মৌলবাদাশ্রয়ী হলে মানবতা বিপন্ন হয়

  • রাজন ভট্টাচার্য   
  • ১৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৮:৪৯

রাষ্ট্র যখন ধর্মান্ধ হয়, মৌলবাদ নীতিকে তোষণ করে, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তখন তাকে সব শক্তি দিয়ে কাবু করা কঠিন। তবে যেকোনো স্বার্থের কাছে নতিস্বীকার করে রাষ্ট্রকে মৌলিক চরিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘটনা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না।

শৈবাল সাহা পার্থর কথা অনেকের মনে থাকার কথা। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন পার্থ। রাষ্ট্রের মৌলবাদী চিন্তা থেকেই একেবারে সাধারণ পরিবারের এই ছেলেটিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দীর্ঘসময় আলোচনা-সমালোচার ঝড় বয়ে যায়। পার্থকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ফুঁসে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ অন্যায়ের প্রতিবাদে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও ভ্রুক্ষেপ করেনি। এর কারণ ছিল একটাই, তা হলো- রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র। রাষ্ট্র যখন ধর্মান্ধ হয়, মৌলবাদ নীতিকে তোষণ করে, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তখন তাকে সব শক্তি দিয়ে কাবু করা কঠিন। তবে যেকোনো স্বার্থের কাছে নতিস্বীকার করে রাষ্ট্রকে মৌলিক চরিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘটনা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না।

দুই.

প্রশ্ন হলো- বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সারা দেশে অন্তত ২০ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা বটে। রাষ্ট্র তখন মৌলবাদী শক্তিকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছিল বলেই কিন্তু একের পর এক এসব ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এ দলটি দেশের সব মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িক প্ল্যাটফরম হিসেবে পরিচিত।

সাধারণ মানুষের এখনও ধারণা নির্যাতিত আর নীপিড়িত মানুষের আশ্রয়ের জায়গা আওয়ামী লীগ। তবে তাদের আমলে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা কেন ঘটছে, বা ঘটবে সেটা বোধগম্য নয়। কেন মিথ্যা অভিযোগে ঝুমন দাসকে মাসের পর মাস কারাভোগ করতে হয়েছে এর সুস্পষ্ট জবাব হয়ত কোনোদিনই মিলবে না। অথচ যারা রাষ্ট্রকে প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, জাতির পিতার ম্যুরাল ভেঙে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার কথা বলে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা প্রত্যাশা ছিল সুনাগরিকদের।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র ভোটের রাজনীতি আর ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। প্রকাশ্যে মৌলবাদী শক্তিকে তোষণ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। নানা সুবিধা দিচ্ছে। এই সুযোগে কিন্তু হেফাজতসহ দেশের সব ধর্মান্ধ ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী বসে নেই। তারা রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে একের পর এক সংখ্যালঘু আর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার মানুষদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ছক অনুযায়ী নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে।

সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় ইস্যুতে ফাঁসিয়ে দিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রসরাজ দাসের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে জেলে পল্লীতে তাণ্ডব চালানো হয়। আক্রান্ত মানুষের বক্তব্য ছিল, ১৯৭১ সালেও এ ধরনের নারকীয় তাণ্ডব তাদের দেখতে হয়নি। দিনের পর দিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেতে হয়েছে সাধারণ পরিবারের সন্তান রসরাজকে। তিনি পেশায় জেলে। রসরাজের মুক্তির জন্য দেশের বিশিষ্টজনসহ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সবাই কথা বলেছেন। প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেছেন। যারা এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের বিচার কি হয়েছে?

এই সাম্প্রদায়িক হামলার মূল হোতা আঁখি চেয়ারম্যান জামিনে মুক্তি পেয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি কিন্তু তাদের লোকদের মুক্তির জন্য প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। নানা কায়দায় চাপ সৃষ্টি করে দোসরদের জামিনে মুক্ত করে এনেছেন। সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ নিরপরাধ মানুষের মুক্তির জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়!

যেমন অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শৈবাল সাহা পার্থর মুক্তির জন্য। ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চারদলীয় জোট সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল এই নিরীহ যুবক। ঘটনার পর পরই ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের হার্ডনেট সাইবার ক্যাফে থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে একটি দৈনিকে ই-মেইল পাঠানোর ঘটনার নাটক সাজানো হয়।

এই নাটক সাজিয়ে ২৫ আগস্ট বোনের বাসা থেকে ওই সাইবার ক্যাফেতে ডেকে এনে একটি বিশেষ গোয়েদা সংস্থার সদস্যরা পার্থকে আটক করে। ৪ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে নির্যাতনের পর ২৯ আগস্ট সিআইডি ইন্সপেক্টর তাকে আদালতে পাঠিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৪ দিন রিমান্ডের মাধ্যমে মালিবাগ সিআইডি অফিসে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বর্বর নির্যাতন চালায়। ২৪ ঘণ্টা চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার পাশাপাশি লাঠিপেটাসহ সব ধরনের নির্যাতন চালানো হয়।

টানা ১৮ দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালে সারাক্ষণ চলেছে অভিনব কায়দায় নির্যাতন আর সাজানো স্বীকারোক্তি আদায়ের চাপ। রাষ্ট্রের মৌলবাদী নীতির জায়গা থেকে এই ঘটনায় একজন সংখ্যালঘু ছেলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ আনা হলেও দেশের মানুষ কিন্তু তা বিশ্বাস করেনি। যেমন বিশ্বাস করেনি নেত্রকোনায় উদীচী অফিসের সামনে বোমা হামলার ঘটনায় একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরপরাধ ছেলের ওপর দায় চাপানোর ঘটনাকেও।

পার্থকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে সারা দেশের মানুষ কিন্তু তখন সোচ্চার হয়েছিল। যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দেশের সব অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেন। বিবৃতি দেন। ছেলের মুক্তির জন্য ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘মা’ নিজের রক্ত দিয়ে পূজা দেন। এ ঘটনা বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। কিন্তু পার্থ যেহেতু ভারতে লেখাপড়া করেছেন, তাই তাকে ভারতের চর হিসেবে প্রমাণেরও চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। দীর্ঘ ৭ মাস কারাভোগের পর হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৫ সালের ২৩ মার্চ কারাগার থেকে মুক্তি পান পার্থ। এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পার্থ ইস্যু যখন কোনোভাবেই সামলাতে পারছিল না তখন তাকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গোটা জাতি দেখেছে জজ মিয়া নাটক।

তিন.

পার্থর ঘটনার পর বাংলাদেশে কি আর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি? আগেই বলেছি, রাষ্ট্র যখন অস্তিত্বের প্রয়োজনে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীকে তোষণের সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে মনে করে। এরই ধারাবাহিকতায় যেকোনো ষড়যন্ত্র করতে সাহস পায়। তাই বার বার আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা দেখছি। সামনের দিনগুলোতে হয়ত আরও দেখতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মৌলবাদী শক্তি ফণা তুলবে এটা সাধারণ মানুষের এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

অনেকে বলেন, যারা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি তারা কীভাবে মৌলবাদী গোষ্ঠীর বলয় থেকে বেরিয়ে আসবে। মৌলবাদী শক্তির ভয়ে রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের কালিমা মেনে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সময় বলছে, আদর্শ বড় নয়- বড় হলো নিজেদের টিকে থাকা। আর টিকে থাকার প্রয়োজনে অনেক সময় আপস করা ছাড়া কোনো পথ নেই।

অনেকে যুক্তি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ১০ ভাগও নয়। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ কত ভাগ? এর বিপরীতে সাম্প্রদায়িক শক্তি কয়েক গুণ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিয়ে আওয়ামী লীগ এক বড় ভোট ব্যাংক নষ্ট করবে? যেখানে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে স্বাগত জানিয়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে।

মূলত একারণেই ঝুমন দাসের মুক্তির জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। শাল্লার নিরপরাধ এই ছেলেটির মুক্তির জন্য অবুঝ সন্তানসহ গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে তার স্ত্রীকেও পথে নামতে হয়েছে। ঝুমনের মুক্তির জন্য কথা বলেছে ছাত্রলীগসহ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। মানববন্ধন, সমাবেশসহ প্রতিবাদী নানা কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ঝুমনের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঝুমনের জামিন হয়েছে। তাও আবার শর্তসাপেক্ষে।

হেফাজতের সাবেক নেতা মামুনুল হকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লার অজপারাগায়ের সন্তান ঝুমন দাস। অতি সম্প্রতি তার এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। তবে এ সময়ের মধ্যে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না বলে শর্ত দিয়েছেন আদালত।

গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলাম এক সমাবেশের আয়োজন করে। সেখানে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঝুমন দাস নামে এক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন বলে অভিযোগ ওঠে।

সেই স্ট্যাটাসটি হেফাজতের দৃষ্টিতে আপত্তিকর মনে হওয়ায় এর প্রতিবাদে সমাবেশ হয়। ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে শান্তির জনপদ হিসেবে খ্যাত শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায় এ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। পরে ১৬ মার্চ রাতে ঝুমন দাসকে আটক করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে শাল্লা থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল করিম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এরপর সে মামলায় গত ৩ আগস্ট নিম্ন আদালতে তার জামিন আবেদন খারিজ করেন আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জামিন চেয়ে গত ২২ আগস্ট তিনি হাইকোর্টে আবেদন জানান।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর