এ এক আশ্চর্য বৈপরীত্য- যারা বিজ্ঞান মানে না, প্রযুক্তির-যুক্তি বিশ্বাস করে না- তারা এ বিজ্ঞানের সব উদ্ভাবনকে ব্যবহার করছে দেশ ও দশের ক্ষতি করার জন্য। অনেকে এদের বলেন প্রযুক্তি-সন্ত্রাসী। ফেসবুকে তারা গুজব রটায়, ইউটিউবে গাঁজাখোরি প্রচার চালায়। ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড পরিচালনায় উৎসাহ দেয়। এক সময় টার্গেট করে বিমান থেকে বোমা ফেলা হতো। কামানদাগা হতো কোনো কিছু ধ্বংস করার জন্য। এখনও করা হয়। এ জন্য বিমানের চালককে সক্রিয় হতে হয়। কামান দাগতে হয় কাউকে। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন দূর-নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ধ্বংসযজ্ঞসাধন করা হয়। মানুষের মন বিষিয়ে দেয়া যায়।
তথ্য-সন্ত্রাসীরাও যেকোনো স্থানে বসে ক্ষতিকর প্রচার চালাতে পারে। এক সময় মাঠ বা রাজপথে সরাসরি কাউকে বক্তব্য রাখতে হতো। বেতার-টেলিভিশন, সংবাদপত্র ব্যবহার করেও বক্তব্য প্রচারের সুযোগ ছিল এবং এখনও আছে। কেউ দেশ ও দশের ক্ষতি হয়, এমন প্রচার চালালে আইনের রক্ষকরা ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু এখন নিজের বাড়িতে বসে কিছু করার দরকার নেই। গোপন যেকোনো স্থানে বসে ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়।
যারা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে, এ লক্ষ্য অর্জন যেন না হয় সেজন্য কাজ করেছে- তারাই এখন ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাতের জন্য, শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের জন্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের কয়েকজন বাংলাদেশের বাইরে পালিয়ে রয়েছে। তারা দণ্ডিত বাংলাদেশের আইনে। তাদের আশ্রয় প্রদান ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে মেনে নেয়ার অবকাশ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় যে দু’জন খুনি বসবাস করছে তাদেরও বাংলাদেশে ফেরত না পাঠাতে নানা অজুহাত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই দেশে থাকা অবস্থাতেই তাদের বাড়িতে- ‘এখানে অবস্থানকারী ব্যক্তি ভয়ংকর, যে বাংলাদেশের জাতির পিতা ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। সে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত’- এমন বিজ্ঞপ্তি লাগিয়ে দিতে সমস্যা কোথায়?
ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশে সামরিকশাসন জারি হবে, এমনটি ভাবা যায়নি। অথচ সেটাই করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর। খন্দকার মোশতাক আহমদ, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এ ভয়ংকর অপরাধে জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করে রেখেছিল। জিয়াউর রহমান খুনিদের চাকরি দিয়েছিল বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে। আত্মস্বীকৃত খুনিরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে নানা দেশে, এটা ভাবা যায়? তারা নিরাপদ অবস্থানে থেকে, কূটনৈতিক মর্যাদা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যে দুষ্টচক্র বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে, তাদের পেছনেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েকজন। তাদের পরিবারের কেউ কেউ এ কাজ করে চলেছে। তারা ধর্মান্ধ চরমপন্থিদের ব্যবহার করছে। গণতান্ত্রিক পথ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য উস্কানি দিচ্ছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটা তারা চায় না। পদ্মা সেতু নিজের অর্থে নির্মিত হচ্ছে, এটা তাদের সহ্য হচ্ছে না। আমরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছি- ব্রিটেনের বিস্ময় টেমস নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হয়েছে যানবাহন চলার পথ। আমি এ পথে হেঁটে টেমস নদী অতিক্রম করেছি।
অথচ এখন কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সুড়ঙ্গপথ তৈরি হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের মতোই যার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। কিন্তু যারা তথ্যসন্ত্রাস চালায় তারা চায়নি পদ্মা সেতু নির্মাণ করুক বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক যখন এ প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ আনে, তারা খুশিতে ডগমগ হয়। এখনও সেতুর পিলারে ফেরির সামান্য ধাক্কা লাগলে তারা আনন্দে নেচে ওঠে।
এদের বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং সে দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে জড়িত সবার। আমরা দেখছি বাংলাদেশে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তথ্যপ্রযুক্তি-সুবিধার অপব্যবহারকে কেবল উৎসাহ দিচ্ছে না, নিজেরাও এতে জড়িয়ে পড়ছে। তারা এটা করছে বাংলাদেশের ভেতরে থেকে এবং বাংলাদেশের বাইরে থেকে। কেউ কি তাদের রুখতে পারবে না?
ধর্মের নামে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায়, তাদের অনেকের ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে। তারা পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা ও ধর্ষণে অংশ নিয়েছিল। তারাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল। এ স্থান তারা বেছে নিয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এখানেই বঙ্গবন্ধু সেই অবিনাশী উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ স্থানেই ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে। এ পরাজয় তাদের গায়ে জ্বালা ধরায়, মনে কষ্ট দেয়।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় এ ধরনের আরও অনেক অপরাধ আমরা সংঘটিত হতে দেখি। তিনি পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানটি অপছন্দ করতেন এবং এ কারণে স্মৃতিস্মারক নির্মাণ না করে সেখানে শিশু পার্ক নির্মাণ করার অনুমোদন দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সরিয়ে দেয়া এমনকি হত্যার অপরাধও তিনি করেছেন। তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য আইন করেছেন। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র কলমের খোঁচায় বাদ দিয়েছেন।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে- এ অভিযোগ তিনি আনেন। এর জের ধরে তিনি ‘শুদ্ধি অভিযান’ পরিচালনা করেন। তবে কেবল চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। আইন ও ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে অনেককে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন। মিথ্যা অভিযোগ আটক ব্যক্তিদের প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়া হয়নি। কী অভিযোগ, সেটা জানানো হয়নি।
ফাঁসির পর পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশও হস্তান্তর করা হয়নি। তখন কঠোর সামরিকশাসন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। বেতার ও টেলিভিশন সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না। প্রকৃতই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে অবস্থা।
যারা এমন অপরাধ করেছে তাদের কি বিচার হবে না- এ দাবি এখন উঠছে। ৪৪ বছর আগে যাদের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে বিনা অপরাধে তাদের সন্তানরা এখন দাবি তুলছেন ইতিহাসের প্রকৃত সত্য তুলে ধরার। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে যারা বিচারের প্রহসন করেছিল, সেই অপরাধীদের কেন বিচার হবে না?
শুরু করেছিলাম তথ্যসন্ত্রাস নিয়ে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে। সামরিক শাসনামলে সত্য চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। মিথ্যাচার যেমন অপরাধ, তেমনি অপরাধ সত্য প্রকাশের সুযোগ কেড়ে নেয়া। সামরিক শাসন জারি করে যারা সব কণ্ঠ রোধ করে রেখেছিল, তাদের বিচার এখন সময়ের দাবি। এটা উপেক্ষা করা যায় না।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।