বাজারে পেঁয়াজের দাম আবার চড়া। খুচরা বাজারে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা গুনতে হয়। দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই মাত্র চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের এই দাম হয়েছে। করোনার পরে এই নিয়ে বেশ কয়েকবার পেঁয়াজের দাম বাড়ল। এর আগে পেঁয়াজের দাম তিনশ’ টাকাও উঠেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ তখন পেঁয়াজ না খাওয়ার মাঝেই সমাধান দেখেছিলেন।
পেঁয়াজ কোনো মৌলিক খাবার না একথা সত্যি। চাল-ডাল, সবজির মতো পণ্য নয়। কিন্তু মৌলিক খাবার না হলেও লবণের মতো পেঁয়াজও একটি অপরিহার্য ভোগ্যপণ্য। লবণ ছাড়া সব খাবারই যেমন বিস্বাদ ও পানসে, পেঁয়াজও সে রকম। বাঙালিদের পেঁয়াজ-মরিচ ছাড়া চলবে কেন? পেঁয়াজ-মরিচ, লবণ-পান্তা বাঙালির আদি ও মৌলিক খাবার।
শুধু পেঁয়াজের দামই বেড়েছে তা নয়। হঠাৎ করে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ভোগ্য পণ্যের দামই বেড়েছে। চাল-ভোজ্যতেল, চিনি-মুরগি ও সবজির দামও এখন চড়া। কাঁচা মরিচের কেজিও দুশ টাকা। পেঁয়াজ খাওয়া না হয় কমিয়ে দেয়া হলো, বা বাদই রইল, কিন্তু চালের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কী বলবে? দেশে কি চালের উৎপাদন, আমদানি বা মজুত কম আছে?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, দেশে বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন ভালোই হয়েছে। তাই সরকারি গুদামে মজুতও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বাড়েনি, বরং কমতির দিকে। সব মিলিয়ে বছরের এ সময়ে চালের দাম কমার কথা। তাহলে চালের দামে আগুনটা দিল কে? পেঁয়াজের দামেও কি তারাই আগুন দিয়েছে? ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ হয়েছে। অথচ উৎপাদন-মজুত, আমদানি সবই ঠিক আছে।
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তাদেরকে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হয়, তাই দাম বাড়তি। যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে খুচরা ব্যবসায়ীরা বরাবর একই কথা বলে থাকেন। এবারও তাই বলছেন। আসলে তারাতো প্রান্তিক বা খুচরা বিক্রেতা। বাজার নিয়ন্ত্রণ এই প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের হাতে থাকে না। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে বড়জোর একটি হাটে কোনো একটি পণ্যের দাম বাড়াতে পারে। কিন্তু দেশজুড়ে পণ্যের দাম বাড়ানো-কমানো তাদের হাতে থাকে না।
পেঁয়াজের বড় ব্যাপারীরা বলেছেন, এখন শীতের শুরু, তাই বাজারে আসা কন্দ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহ নেই। আর নতুন পেঁয়াজ এখনও উঠতে শুরু করেনি। তাই পেঁয়াজের দাম চড়া। অকাট্য যুক্তি। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের আগে জানা ছিল না! যদি থাকে তবে আগে থেকেই পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়নি কেন?
আসলে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ চাপাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর, পাইকারি ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের ওপর, আড়তদাররা মজুতদার বা স্টোরেজ মালিকদের ওপর। আর আমদানিকারকরা বলছে বিদেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।
আমদানিকারকরা বলছে বন্যায় ভারতীয় পেঁয়াজ কম আসায় দাম বেড়েছে। গত বছরও এসময়ে ভারতের বন্যার অজুহাতে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এসময় বন্যা হলে আগে থেকেই মজুত বাড়িয়ে রাখা হলো না কেন, অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হলো না কেন? এ ব্যাপারে আগে থেকেই পদক্ষেপ নিলে হয়তো বাজারে এই অস্থিরতা বিরাজ করত না। নাকি এসবই দেশীয় অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজি?
একদিকে করোনা, আরেকদিকে দেশের কিছু এলাকায় বন্যা। এই দ্বিমুখী দুর্যোগে মানুষর জীবন সঙ্গিন। এর মধ্যে আবার নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। সবাই নির্বিকার। বিষয়টি শুধু পেঁয়াজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে বুঝতাম। কিন্তু তেল-নুন, চাল-চিনি, মরিচের দামও যে বাড়তি। মানুষ তাহলে যাবে কোথায়?
টিসিবি কিছু পণ্য বিক্রি ছাড়া মূল্য নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। হয়তো ভেতরে ভেতরে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তাদের কাজের কোনো ইতিবাচক প্রভাব সহসা চোখে পড়ে না। এদেশে বাসের ভাড়া বাড়লে কন্ডাক্টর বলে বিদেশে তেলের দাম বেড়েছে।
যদিও ওইসব বাস চলে সিএনজিতে। তারপরও বিদেশে তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের লোকাল বাসের ভাড়াও বাড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনভাবে বিদেশে মানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে ওই বাসের ভাড়া আর কমে না। এভাবেই বাংলাদেশে জীবনযাত্রা আজ ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। তেলের মতো পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরাও এখন আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিচ্ছেন।
করোনায় অনেক মানুষ বেকার হয়েছেন, অনেকের রোজগার কমে গেছে। মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। কিন্তু সিন্ডিকেটকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই সিন্ডিকেটের জন্যই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। নিত্যপণ্যের দাম বাড়া দেশে নতুন কিছু নয়।
প্রশ্ন হলো- সিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? কারণ অতীতে আমরা কখনোই কোনো সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখিনি। সে পেঁয়াজই হোক, হোক চাল-ডাল অথবা পরিবহন। সিন্ডিকেটের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের কোনো বোঝাপড়া বা লেনদেন আছে কি না সেটা একটা প্রশ্ন। তা না-হলে সরকারও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সব কিছুর খেসারত কেন জনগণকেই দিতে হয়।
গত বছরও সেপ্টেম্বর মাসেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছিল যে, সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজের দাম বাড়বে না। আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে না বাড়লেও একমাস পরে ঠিকই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হলো। সেই পুরনো অসাধু ব্যবসায়ীরাই এবছরও কাজটি করেছে; এবং আগামীতেও হয়তো করেই যাবে।
টিসিবি বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল দাম বাড়লে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ ভর্তুকিমূল্যে বাজারে ছাড়া হবে। সে পেঁয়াজ কোথায়? বলা হয়েছিল, এবার পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে ব্যবসায়ী লাইসেন্স বাতিল, প্রতিষ্ঠান সিলগালা এমনকি দোষীদের জেলে পাঠানো হবে। কোথায় সে ব্যবস্থা? কেউ কি জেলে গেছে? মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে চলছে সেই একই তেলেসমাতি। পেঁয়াজ আমদানি থেকে শুরু করে বা কৃষকের কাছ থেকে পেঁয়াজ কেনা থেকে শুরু করে তা পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত চলে এ তেলেসমাতি। কোথাও কোনো মনিটরিং নেই।
সাধারণ মানুষ এমনিতেই নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যে যদি নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের জোয়াল তাদের কাঁধে তুলে দেয়া হয় তবে তারা যাবে কোথায়, খাবে কী?
হয়তো এ দাম ঠিকই কমে যাবে। কিন্তু প্রতি মৌসুমে কারসাজি করে প্রান্তিক ভোক্তা ও ক্রেতাদের জিম্মি করে বাড়তি টাকা আদায়ের এই অনৈতিক বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ করতে হবে। এটা ফৌজদারি অপরাধ। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
লাইসেন্স বাতিল বা শুধু হুমকি-ধামকি দিয়ে কাজ হবে না। ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে ফড়িয়া-সিন্ডিকেটের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন, ক্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক