বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশুশ্রম ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার দায়

  • মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ   
  • ৬ অক্টোবর, ২০২১ ১৮:১২

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির ফলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কলকারখানায় কাজ করা শিশুরা রাসায়নিক পদার্থ ও দূষিত পরিবেশের সংস্পর্শে আসে। ফলে কম বয়সেই চোখের অসুখ, ফুসফুসের নানা সমস্যা, এমনকি ক্যানসারের মতো মারণরোগেরও শিকার হয়। এছাড়া শৈশবের প্রাপ্য হিসেবে প্রাথমিক যত্ন এবং শিক্ষালাভ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। ফলে সময়ের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে।

শিশুর মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং যৌবনে উত্তীর্ণ হলে সে সম্ভাবনা বিকাশের মাধ্যমে তা সমাজ গড়তে সাহায্য করে। কিন্তু শিশু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক থাকে না। পরিবারের মতাদর্শগত ত্রুটি, অর্থাভাবসহ নানা কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশু অর্থের বিনিময়ে শ্রম দিতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ কোনো শক্ত ভিতের ওপর গড়ে ওঠতে পারে না। বিভিন্ন কারণে এ শিশুরা তাদের প্রাপ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হয়। এ সমস্যা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, রাজ্য কিংবা দেশে সীমাবদ্ধ না। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এটি বর্তমান।

সাধারণত ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ১৪ বছর বয়সের নিচে ছেলেমেয়েরা শিশু হিসেবে গণ্য। এ বয়সের অনেকে কখনও পরিবারের অভাব, কখনও নিতান্ত পেটের জ্বালায় খেত-খামার, খনি, লোকের বাড়ি, দোকান বা রেস্তোরাঁর মতো জায়গায় কাজ করে। এ বয়সে শিশুদের মন বা শরীরের পূর্ণ বিকাশ হয় না। ফলে এসব শিশুরা মানসিকভাবে যেমন পঙ্গু হয়, তেমনি তাদের শরীরও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

ইউনিসেফ বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ৯ কোটি ৪০ লাখ ছিল। প্রতিবেদনে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ নির্দিষ্টভাবে বলা আছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া যাবে না।

পৃথিবীতে শিশুশ্রম যেমন একেবারে নতুন নয়, তেমন খুব বেশি পুরোনোও নয়। মধ্যযুগের প্রথমদিকে শুরু হয় দুর্বলের ওপর সবলের শোষণের ইতিহাস। শিশুশ্রমের শুরুও এ সময়। তারপর বিজ্ঞান যত উন্নত হয়, পৃথিবীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানা যত বাড়ে ততই নামমাত্র মজুরিতে সেখানে শিশুদের নিয়োগ প্রচলিত হয়। শিশু নিয়োগের অন্যতম কারণ হচ্ছে- তাদের দিনরাত খাটানো যায়।

বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকরা প্রায় ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। যার মধ্যে ৪৭ ধরনের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা, ট্যানারিশিল্প, যৌনকর্ম, বিড়ি ও তামাক ফ্যাক্টরি, পরিবহন খাত, আবর্জনা সংগ্রহ, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, অটোমোবাইল কারখানা, লবণ কারখানা, রিকশা ও ভ্যান চালানো, কাঠমিস্ত্রির কাজ, জুয়েলারি শিল্প, চাল ও মশলার কারখানা, ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা এবং মাদকদ্রব্য বিক্রি।

বিশ্বজুড়ে শিশুশ্রমের ধারাবাহিকতার কারণ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক দুটিকে আলাদা করে আলোচনা করলে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এক্ষেত্রে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক দুটি পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৬ শতাংশ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই মানুষগুলোর দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারেরও নিচে। অর্থাৎ এখান থেকে পরিষ্কার হয় যে, একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও সবার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের বন্দোবস্তও হয়নি।

বিশ্বের বিপুল মানুষের খাদ্যের অভাব, নিম্নমানের জীবনধারা প্রাথমিকভাবে শিশুশ্রমে ইন্ধন দেয়। তদুপরি চূড়ান্ত এ আর্থিক অনটনের নিরক্ষর মানুষের মনে সমাজ তথা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আদৌ কোনো সচেতনতা গড়ে ওঠে না। দারিদ্র্যে ডুবে থাকা মানুষের মধ্যে ‘যত বেশি হাত, তত বেশি ভাত’ তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পায়।

এশিয়া তথা আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কারণে এ সমস্ত জায়গার মানুষের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক করুণ। ভারতীয় উপমহাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। শুধু ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা বিশাল অঙ্কের।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির ফলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কলকারখানায় কাজ করা শিশুরা রাসায়নিক পদার্থ ও দূষিত পরিবেশের সংস্পর্শে আসে। ফলে কম বয়সেই চোখের অসুখ, ফুসফুসের নানা সমস্যা, এমনকি ক্যানসারের মতো মারণরোগেরও শিকার হয়। এছাড়া শৈশবের প্রাপ্য হিসেবে প্রাথমিক যত্ন এবং শিক্ষালাভ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। ফলে সময়ের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে। সেজন্য যে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা যত বেশি, অর্থনৈতিকভাবে সেই দেশের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ানো ততবেশি কঠিন।

এ সমস্যা দূরীকরণে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। সবার আগে প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার প্রসার, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণ। এছাড়াও প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা ও সামাজিক সচেতনতা। এছাড়া শিশুশ্রমের প্রচলিত ধারা রোধ করার জন্য সরকারের তরফে আইনগুলোকে যথাযথভাবে কার্যকরী করার দিকেও নজর রাখা দরকার। এ সমস্যা কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা মহাদেশের নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে বিশ্ববাসীকে একত্রিত হয়ে এই সমস্যা দূরীকরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

পৃথিবীজুড়ে স্থাপিত হয়েছে নানা আন্তর্জাতিক সংগঠন। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শাখা হিসেবে এ সমস্যা দূরীকরণে চেষ্টা করছে ইউনেসকো। বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের প্রচলিত এই ধারাকে প্রতিহত করার জন্যে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইন।

কেবল আইন দিয়েই কোনো সামাজিক সমস্যার বাস্তব সমাধান কোনোদিন সম্ভব নয়। তাই সবাইকে এককভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে শিশুশ্রম সমস্যা দূরীকরণে। এই সংকল্প উঠে আসতে হবে সমাজের একেবারে নিচু স্তর থেকে। তৃণমূল স্তর থেকে সামাজিক ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য। সমাজের একক ও প্রথম অঙ্গ হলো পরিবার।

প্রতিটি পরিবারে যদি এই জ্বলন্ত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় তাহলে শিশুশ্রমিক সমস্যা দূরীকরণে পৃথিবীতে আর বেগ পেতে হবে না। সঠিকভাবে দেশকে পরিচালনা করতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা। একমাত্র সঠিক শিক্ষাই পারে কুসংস্কার-দুর্নীতিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আজও বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পারিবারিক অভাব ও অনাথ শিশুদের ক্ষুধার জ্বালা তাদের বাধ্য করেছে শিক্ষার পথ ত্যাগ করে শ্রম দিতে। আমাদের সবার কর্তব্য এই শিশু শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো।

মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রম রোধ করা একান্ত প্রয়োজন। শিশুরা জাতির সম্পদ। তাই বন্ধ হোক ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। শিশু শ্রমিকের সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থব্যয়ের অক্ষমতার চেয়ে আমাদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবই বহুলাংশে দায়ী। আশা করা যায় জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যথাযথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই শিশুর দল ফিরে পাবে তাদের স্বাভাবিক জীবন এবং এই শিশুর দল সুস্বাস্থ্য এবং সুশিক্ষার অধিকারী হয়ে ভবিষ্যতে গড়ে তুলবে এক উন্নত সমাজ ও সভ্যতা। প্রত্যেক শিশুই এক একজন ভবিষ্যতের মানব। এই শিশুদের মাঝেই সুপ্ত থাকে ভবিষ্যৎ মানবের সব শক্তি ও সম্ভাবনা।

আজকের শিশু আগামীদিনে পরিচালনা করবে দেশ ও সমাজ; গড়ে তুলবে সভ্যতার নতুন ইমারত। সেজন্যই প্রত্যেকটি শিশু যাতে সব দিক থেকে উপযুক্ত পরিবেশ তথা যথোপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। এই পৃথিবীতে সম্ভবত শিশুরাই সবচেয়ে বেশি নিষ্পাপ। কিন্তু নানান কারণে আজ সেসব নিষ্পাপ ছোট শিশুরা তাদের প্রাপ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত। শিশুকে তার প্রাপ্য পূর্ণ অধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে পারলেই সার্থক হবে বাংলাদেশ। শিশুদের প্রতি আমাদের এই বঞ্চনা শুধু শিশুদেরকেই বঞ্চনা করা নয়, বরং আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের চূড়ান্ত সম্ভাবনাকে অবহেলা করে অন্ধকারের মুখে ঠেলে দেয়া।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর