বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সম্প্রচার বন্ধ নিয়ে পুনরায় ভাববার অবকাশ আছে

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৬ অক্টোবর, ২০২১ ১৫:১১

বাংলাদেশে ‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬’-এর ১৯ ধারার ১৩ উপধারায় বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে যারা বিদেশি চ্যানেলের নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখে অভ্যস্ত, তারা আকস্মিকই বিড়ম্বনায় পড়েছেন। চেনা চ্যানেলের পরিচিত অনুষ্ঠানগুলো আর দেখতে পাচ্ছেন না। কিছু মানুষের কাছে টিভি অনুষ্ঠানগুলো নেশার মতো। হঠাৎ ছেদ হলে মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক দর্শকেরও এখন মাথা খারাপ অবস্থা! বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে౼ এমন সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়ায় এই বিপত্তি ঘটেছে।

বিবিসি, সিএনএনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল, খেলাধুলার চ্যানেল এবং ভারতীয় চ্যানেলসহ সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার গত ১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে বন্ধ রয়েছে। গত এপ্রিলে একবার সরকার এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা পিছিয়ে ১ অক্টোবর করা হয়।

সরকার বলছে যাদের মাধ্যমে দর্শক বিদেশি চ্যানেল দেখতে পাচ্ছেন, তারাই ওই বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন ছাড়া সম্প্রচার করবে। বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই। এদিকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কেবল অপারেটর ও ডিটিএইচ সংযোগ প্রদানকারীরা বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনমুক্ত করার পথে না গিয়ে সেগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়।

ফলে বিপাকে পড়েছেন বিপুলসংখ্যক দর্শক। তারা এখন বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া বিদেশি কোনো চ্যানেল দেখতে পাচ্ছেন না। এতে করে দর্শকরা কেবল অপারেটরদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন। তাদের প্রশ্ন এর সমাধান কোথায়? বিদেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনমুক্ত কে করবে? আর তা যদি না হয়, তাহলে কি বিদেশি চ্যানেলগুলো স্থায়ী ভিত্তিতে বন্ধ হয়ে যাবে?

বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। সরকার বলছে, তাদের করণীয় কিছু নেই। বিজ্ঞাপনসহ চ্যানেলের সম্প্রচার দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। অপরদিকে কেবল অপারেটরেরা বলছেন, বিজ্ঞাপন ছাড়া (ক্লিন ফিড) চ্যানেলের সম্প্রচার করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, টেলিভিশন (টিভি) প্রযুক্তিতে একটি টিভি স্টেশন থেকে গ্রাহকদের উদ্দেশে যা কিছু সম্প্রচার বা ব্রডকাস্ট করা হয় তা হলো ফিড। টিভি ফিডে মূল কন্টেন্ট সম্প্রচারের পাশাপাশি অতিরিক্ত টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিও ব্রডকাস্ট করা হয়ে থাকে, যা সাধারণত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রচারিত টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিওকে বিজ্ঞাপন বলে চিহ্নিত করা হয়।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই অন্য কোনো দেশের টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতির ক্ষেত্রে শর্ত দেয়া হয় যে, টেলিভিশন চ্যানেলটি কোনোভাবেই দেশের দর্শকদের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না। এর জন্য আলাদা আইন কিংবা নীতি প্রণয়ন করা হয়। দেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের নিজেদের বা যেই দেশের চ্যানেল সেই দেশের বিজ্ঞাপনমুক্ত সম্প্রচার কার্যক্রমের যে নীতি কোনো দেশ গ্রহণ করে౼ তাকে টেলিভিশন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ক্লিন ফিড নীতি বলে।

বাংলাদেশে ‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬’-এর ১৯ ধারার ১৩ উপধারায় বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

একটি দেশে ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হবে౼এটা নতুন কোনো ধারণা নয়। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হয়। তা হলে প্রশ্নে উঠেছে বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়?

দুভাবে এটি হতে পারে। যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার হয়- সেসব চ্যানেল কাস্টমাইজ করে অর্থাৎ বাংলাদেশে তাদের চ্যানেল বিজ্ঞাপনহীন করে ডাউনলিংক করার ব্যবস্থা করতে পারে। অথবা বাংলাদেশে যারা স্যাটেলাইট থেকে চ্যানেল ডাউনলিংক করেন তারা চ্যানেলে অনুষ্ঠানের ফাঁকে থাকা বিজ্ঞাপন বাদ দিতে পারেন।

কেবল অপারেটেরা বলছেন, চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের জন্য আলাদা ফিড দেবে౼ এটা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত নয়। এতে যদি ওই চ্যানেলের এ দেশে সম্প্রচারের ব্যাপকভাবে আর্থিক লাভের সুযোগ না থাকে, তাহলে সেটি তারা করবে না। এরপর থাকল বাংলাদেশে যারা ডাউনলিংক করছে অর্থাৎ কেবল অপারেটর বা ডিটিএইচ সংযোগকারী। তারাও বিদেশি চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করতে আগ্রহী নয়। কারণ বিজ্ঞাপনমুক্ত করে বা ক্লিন ফিড করে চ্যানেল সম্প্রচার করা কেবল অপারেটরদের জন্য ব্যয়বহুল। এ কারণে তারা এটা করতে চান না।

ক্লিন ফিড না হলে দর্শকদের ক্ষতি নেই, ক্ষতি হচ্ছে দেশীয় বিজ্ঞাপনদাতাদের। বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলের দর্শক। এ ছাড়া বিদেশি সিনেমা দেখানো হয়౼ এমন চ্যানেলেরও দর্শক রয়েছে। এসব চ্যানেলে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। ওই বিদেশি পণ্য বাংলাদেশের বাজারেও বিক্রি হয়। সে ক্ষেত্রে এই পণ্য দিয়ে বাংলাদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না পণ্য আমদানিকারকেরা। এতে দেশীয় চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দেশীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন এলে বাংলাদেশ সরকার ট্যাক্স পায়। সে ক্ষেত্রে সরকারও লাভবান হয়। সরকার বলছে, বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত না হওয়ায় এ খাতে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞাপনহীন বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করলেই কি দেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন আসবে? দেশি চ্যানেলগুলোর টিআরপি কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয় না। আর টিআরপি না বাড়লে বিদেশি বিজ্ঞাপন পাবার সম্ভাবনা খুব কম।

সে ক্ষেত্রে বরং গ্রাহকদের একটা বড় অংশ ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে যেতে পারে। এতে করে কেবল অপারেটরদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুরূহ হবে। মানুষ যদি দলে দলে কেবল-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তাহলে এই খাতে কর্মরত প্রায় চার লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

ইউটিউবের এখন রমরমা অবস্থা। যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে বন্ধ হয়েছে, সেসব চ্যানেল তাদের প্রতিটি সিরিয়াল সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবে আপলোড করে দিচ্ছে। সেখানে কিন্তু বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন ইউটিউবে যাচ্ছে। এই টাকাটা কিন্তু চলে যাচ্ছে ইউটিউব কোম্পানির কাছে। দেশের বাইরে থেকে অনেকগুলো অ্যাপস চলছে। এরা অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশি গ্রাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

‘ক্লিন ফিড’ নীতির মূল কথা হচ্ছে অন্য দেশের চ্যানেলে ওই দেশের বিজ্ঞাপন না দেখিয়ে নিজদেশের বিজ্ঞাপন দেখানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: যখন কোনো খেলা অনুষ্ঠিত হয় তখন ওই খেলা একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়। একই খেলা একই সময়ে সম্প্রচারিত হলেও প্রতিটি চ্যানেলে আলাদা বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। একই কন্টেন্ট একইসঙ্গে সম্প্রচারিত হওয়ার পরও প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল নিজেদের মতো করে বিজ্ঞাপন প্রচার করার সুযোগ পায়, এই ব্যবস্থাটিই হলো টেলিভিশন প্রযুক্তির ক্লিন ফিড পদ্ধতি।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বিদেশি চ্যানেলে ৩০ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে ২০ মিনিট মূল কন্টেন্ট এবং ১০ মিনিট বিজ্ঞান প্রচার করা হলে, ক্লিন ফিড নীতির কারণে বিজ্ঞাপনের এই ১০ মিনিট সমন্বয় করা হবে কীভাবে? সেটাও সহজ। যতটুকু সময় সেই দেশের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তা না দেখিয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। অর্থাৎ, চ্যানেল অন্য দেশের; বিজ্ঞাপন আমাদের দেশের।

ক্লিন ফিডের ক্ষেত্রে ব্রডকাস্টাররা নানা কথা বলছেন। কখনও ছোট মার্কেটের দোহাই দিচ্ছেন। কখনও সরকারের কাছে প্রস্তুতির জন্য সময় চাইছেন। তাদের মতে, করোনায় যন্ত্রাংশের স্বল্পতা আছে। ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন করতে গেলে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচশ কন্ট্রোল রুমের যে বক্স সরবরাহ করা আছে, সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে। স্যাটেলাইটের ফিড চেঞ্জ করতে হবে। এগুলো করতে সময় লাগবে। একটা যৌক্তিক সময় নির্ধারণের পর এই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যথায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি যদি চলমান থাকে, তাহলে হয়তো তাদের পক্ষে আর ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।

ব্রডকাস্টারের কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু সবার আগে দর্শকদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ থাকায় সাধারণ দর্শকদের ক্ষোভ বাড়ছে। অনেকেই ক্যাবল অপারেটরদের ফোন করে গালাগাল করছেন। গৃহিণী, প্রবীণ ও শিশু౼ এই তিন শ্রেণির মানুষ সাধারণত বিদেশি চ্যানেলের প্রধান দর্শক। হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ হওয়ায় তাদের অনেকেই অস্থিরতায় ভুগছেন। বিশেষ করে যারা টিভি সিরিয়াল দেখেন তারা নাটকের পর্ব মিস করছেন। বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো দর্শকদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বিদেশি চ্যানেলের জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

এখন সেসব চ্যানেল দেখতে না পাওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। বিষয়টির দ্রুত সুরাহা করতে হবে। বিদেশি টিভি চ্যানেল থেকে যারা বিনোদন পান তারা কিন্তু বিজ্ঞাপনের ধার ধারেন না। তারা চান এসব চ্যানেল দেখার অবারিত সুযোগ। এর অন্যথা হলে সব রাগ-ক্ষোভ গিয়ে জমা হবে সরকারের ওপর। কাজেই এ ব্যাপারে যা করার সরকারকেই করতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর