বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রিমান্ড মানে যেন হয় ভয়-ভীতির কিছু নয়

  •    
  • ৫ অক্টোবর, ২০২১ ১৭:২৫

রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়, তা মোটামুটি সবাই জানেন। না জানারও কোনো কারণ নেই। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অনেকেই রিমান্ডে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে বইপত্রও লিখেছেন। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের নাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’। অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের একটা বইয়ের নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগস্টের ঘটনা গ্রেপ্তার রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’। অধ্যাপক ড. মো আনোয়ার হোসেনের বইয়ের নাম ‘কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’। এরকম আরও অনেকেই বই লিখেছেন।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় ‘রিমান্ড’ একটি আতঙ্কের নাম— যা নতুন করে আলোচনায় এসেছে পর পর দুজন আলোচিত ব্যক্তির কারণে। একটি মামলায় পর পর তিনবার চিত্রনায়িকা পরীমনিকে রিমান্ডে দিয়ে যেমন হাইকোর্টে ভর্ৎসনার শিকার হয়েছেন নিম্ন আদালতের দুজন বিচারক; তেমনি নানারকম উদ্ভট কথা বলে আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত ইসলামিক বক্তা মুফতি ইব্রাহিমের রিমান্ড শুনানিতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর আদালত তাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘রিমান্ড মানে আপনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জিজ্ঞাসা করবে। আপনাকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠিকমতো উত্তর দেবেন। রিমান্ড মানে অন্য কিছু না যে মারধর করবে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। রিমান্ড মানে ভয়-ভীতির কিছু না।’

রিমান্ড মানে আসলেই ভয়-ভীতির কিছু নয়? মুফতি ইব্রাহিমের রিমান্ড শুনানিতেই তার আইনজীবী সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘গত ১০ বছরে ২-৩ হাজার মানুষকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিমান্ড শেষে দেখা গেছে অনেকে ঠিকমতো হাঁটতে পারে না।’ সুতরাং, রিমান্ড মানে ভয়-ভীতির কিছু নয় বলে আদালত যে মুফতি ইব্রাহিমকে আশ্বস্ত করেছেন, তার ব্যতিক্রমও আছে। এমনকি মুফতি ইব্রাহিমও আদালতকে বলেন, ‘রিমান্ডের আগেই মার খেয়েছি।’ তিনি নিজের একটি হাত উঁচিয়ে দেখান এবং বলেন এই হাতে ব্যথা।

শুধু রিমান্ড নয়, আসামিদের প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণও অনেক সময় নানারকম প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন অনেক বড় অপরাধীকে হাতকড়া না পরানো হলেও অনেক সময়ই দেখা গেছে সাংবাদিকদের হাতকড়া এমনকি দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রবীর সিকদারের মতো সৎ ও সাহসী সাংবাদিককে আমরা দেখেছি। তার একটি পা সন্ত্রাসী হামলায় হারিয়েছেন অনেক বছর আগে। দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাকে নিয়ে নেই। তবু তাকে হাতকড়া পরানো হয়েছে। শুধু লেখা ও মতপ্রকাশের দায়ে।

মুফতি ইব্রাহিমের শুনানিতেও তার আইনজীবী বলেছেন, পরীমনি আদালতে এলে আনন্দ হয়। তাকে সানন্দে গ্রহণ করা হয়। অথচ একজন আলেমকে দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হলো।

রিমান্ড প্রসঙ্গে আসা যাক। গত বছরের ২৮ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক, লেখক ও শিক্ষক আফসান চৌধুরী ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন এরকম- ‘রিমান্ডে কী হয়, কারও অভিজ্ঞতা আছে?’

সেখানে প্রায় অর্ধশত মানুষ নানারকম মতামত দেন বা কমেন্ট করেন। এর মধ্যে শামস রুবেল নামে একজন লেখেন- ‘বাটপার শাহেদ আর অপদার্থ প্রদীপ বলতে পারবে।’ নওশিন শর্মিলী নামে আরেকজন লিখেছেন- ‘রিমান্ডে কী হয় সেটা নির্ভর করে কত টাকা ঢালা হচ্ছে তার ওপর।’

নাদিরা খানম নামে আরেকজনের মন্তব্য - ‘এমন কিছু হয় যে, খুন না করেও বলে খুন করেছি।’ সুমন এহসানুল ইসলাম নামে একজন এ প্রসঙ্গে একটি গল্প শেয়ার করেন, ‘তরুণ এক পুলিশ নতুন বিয়ে করেছেন। সহকর্মীর সাথে চটুল আলাপে বললেন, কি বিয়া করলাম, বউ তো কথা কয় না। সহকর্মীর উত্তর- রিমান্ডে নে। কথা কইব না মানে, বউয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী কথা কইব।’ এরকম বিচিত্র সব কমেন্ট করেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। যার অধিকাংশই রসিকতায় পূর্ণ।

তার মানে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়, তা মোটামুটি সবাই জানেন। না জানারও কোনো কারণ নেই। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের অনেকেই রিমান্ডে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে বইপত্রও লিখেছেন।

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের নাম ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’। অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের একটা বইয়ের নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগস্টের ঘটনা গ্রেপ্তার রিমান্ড ও কারাগারের দিনগুলি’। অধ্যাপক ড. মো আনোয়ার হোসেনের বইয়ের নাম ‘কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’। এরকম আরও অনেকেই বই লিখেছেন।

সুতরাং রিমান্ডে কী হয়, সেটি কারো অজানা নয়। দেশের অত্যন্ত সম্মানজনক মানুষ ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদেরও রিমান্ডে নিয়ে যে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়- সেটিও নতুন কোনো খবর নয়; কিন্তু কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার পুলিশ কর্মকর্তাদের রিমান্ডে নিয়েও যে সেই একইভাবে পেটানো হবে- সেটি বোধ হয় কারো কল্পনায়ও ছিল না; কিন্তু ওসি প্রদীপ এবং পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর টেলিফোন আলাপে সেটি আলোচনায় আসে। রিমান্ড যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় বাণিজ্য— তাও সবার জানা। বিশেষ করে পয়সাওয়ালা ও প্রভাবশালীদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের গায়ে হাত না দেয়ার শর্তে যে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়; রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে যে ব্ল্যাকমেইল করা হয়— সেই অভিযোগও নতুন নয়।

রিমান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বড় যে যুক্তি দেয়া হয় তা হলো- আসামির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়। অর্থাৎ রিমান্ডে নির্যাতন না করলে কোনো আসামিই অপরাধ স্বীকার করবেন না এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে। কিন্তু সত্যিকারের নিরপরাধ লোককেও যদি রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হয়, সেটি স্পষ্টতই ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। সেক্ষেত্রে সামধান কী? সমাধান হচ্ছে, শারীরিক নির্যাতনের বিকল্প উপায়ে আসামির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের ব্যবস্থা করা এবং অপরাধ ও অপরাধী খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীর আরও বেশি চৌকষ হওয়া।

তাদের তদন্ত রিপোর্ট যদি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ হয়, তারা যদি সত্যিই পেশাদারত্ব বজায় রেখে মামলার তদন্ত করে, সেক্ষেত্রে আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রক্ষাকারী সেই কাজটি করতে চায় না।

কারণ তারা দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে প্রতিটি মামলাকেই নিজেদের পয়সা আয়ের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে। মামলা মানেই উপরি; রিমান্ড মানেই মোটা অঙ্কের টাকা। যে কারণে রিমান্ডে এখন আর বিচারিক প্রক্রিয়ায় সহায়ক কোনো অনুষঙ্গ নয়, বরং এটি এক আতঙ্কের নাম। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার।

প্রসঙ্গত, সন্দেহভাজন আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল ১৫ দফা নির্দেশনাসহ একটি যুগান্তকারী রায় দেন হাইকোর্ট, যা ২০১৬ সালে বহাল রাখেন আপিল বিভাগও। রায়ে আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং রিমান্ডে নেয়ার বিষয়ে ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু উল্লিখিত দুটি ধারা সংশোধন করে আপিল বিভাগের নির্দেশনা এখনও যুক্ত করা হয়নি। ফলে পুলিশ নানা অজুহাতে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে, কখনও জোর করে আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে— এমন অভিযোগও পুরোনো।

শুধু তাই নয়, নির্যাতনে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুও হচ্ছে। প্রশ্ন হলো- রিমান্ডে নির্যাতনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অমান্য করে, তাহলে সেটি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে কি না? নাকি এটিকেও আর দশটি ঘটনার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবজনিত ত্রুটি বলে বিবেচনা করা হবে?

উচ্চ আদালতের ওই ১৫ দফা নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- আটক ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে পুলিশ তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে। আটক ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন; কিন্তু অনেক সময় আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন বা এরও চেয়ে বেশি রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। আবার আদালত তা মঞ্জুরও করেন।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুরোধে দেশে একটি আইন আছে। যেখানে বলা হয়েছে, হেফাজতে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন। আইনে আরও বলা হয়েছে, কাউকে হেফাজতে নির্যাতনের ফলে যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে নির্যাতনকারী অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।

সাম্প্রতিক সময়ে রিমান্ড নিয়ে বেশি আলোচনা হয় চিত্রনায়িকা পরীমনি ইস্যুতে। একজন নারীকে পর পর তিন দফায় রিমান্ডে নেয়া যায় কি না— তা নিয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বিষয়টির সমালোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে হাইকোর্ট দুজন বিচারককে তলব করেন এবং তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে ক্ষমা চান। প্রশ্ন হলো- রিমান্ড কখন কাকে কোন পরিস্থিতিতে দেয়া যায়, সেটা না জেনেই কি তারা বিচারক হয়েছেন?

কবি সিকানদার কবীর ফেসবুকে রিমান্ড নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন এরকম: ‘রিমান্ড একটি ছেলের নাম। ছেলেটি উদার ও মহৎ। সে সব দোষ নিজে স্বীকার করে নেয়। অপরাধ না করেও হাকিমের সামনে কথাশিল্পীর মতো নিজের অপরাধের বর্ণনা দিতে পারে। তার গায়ে বেআইনিভাবে কেউ একটা টোকা পর্যন্ত দেয় না। কিন্তু কেন সে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কেন তার শরীরে জখম, চোখ দুটি কেন রক্তাক্ত ফোলা, এসব প্রশ্নে রিমান্ড হাসি দিয়ে বলে, এগুলো কিছু না স্যার। এ উপন্যাসের নাম ১৬৪ ধারা।’

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর