মাস দুয়েক আগে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম করোনা-পরবর্তী সম্ভাব্য সামাজিক সমস্যা নিয়ে। তাতে যে সমস্যাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করি তা হলো- স্কুল-কলেজ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় এবং করোনাজনিত কারণে কাকে যে কখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় তা অনুমান করা অসম্ভব, তাই মানুষের অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তাজনিত উদ্বেগের কারণে যেসব সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শিশুকন্যাদের বাল্যবিবাহের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং অকাল মাতৃত্ব।
সমাজের কাছে বিষয় দুটি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আশঙ্কাগুলো যে প্রকৃতই সত্যে পরিণত হয়েছে তা সম্প্রতি গণমাধ্যমের দিকে চোখ রাখলে স্পষ্ট বোঝা যায়।
আরও একটি বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। তাহলো- যেহেতু পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে করোনায় মৃতের যে সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ করছিল, অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকবে, বিগত ১৯ মাসে করোনায় মৃতের সংখ্যা নারীর তুলানায় পুরুষের আধিক্য। মাঝে মধ্যে নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা পুরুষের চাইতে কিছুটা বেশি হলেও তাতে সাকুল্য মৃত্যুর বিবেচনায় নারী-পুরুষের করোনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানে তেমন হেরফের ঘটে না।
নারীমৃত্যু ঘটেছে পুরুষের মৃত্যুর অর্ধেক। ফলে সমাজে নারী-পুরুষের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং তা যদি আরও কিছুদিন চলতে থাকে তবে আমাদের দেশে একটা গুরুতর সামাজিক সংকট দেখা দিতে পারে। হয়তো সমগ্র পৃথিবীতেই।
অনুমান করি, উল্লেখযোগ্যভাবে না হলেও এ সামাজিক ভারসাম্যের কম-বেশি প্রতিক্রিয়া ধীরে হলেও দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এর একটি লক্ষণ হলো- বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, ইতোমধ্যেই সহস্রাধিক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকারে পরিণত হয়েছে। আর তা রেজিস্ট্রি করে এবং গোপন না করে। আর করোনাকালে গোপনে কোনো অনুষ্ঠান করা কঠিন নয়, কারণ কাউকে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করার প্রয়োজন থাকে না। থাকলেও জনসমাগম নিষিদ্ধ হওয়ায় অনেকেই তা এড়িয়ে চলে।
বাল্যবিবাহের রেজিস্ট্রেশন করাও বাংলাদেশে কঠিন কিছু নয়। পাত্র-পাত্রী যতই নাবালক হোক না কেন, অসাধু রেজিস্ট্রাররা বরং বিপদের ভয় দেখিয়ে মোটা ফি আদায় করতে পারছে। বলা যায়, এ সমস্যাটিই অকাল মাতৃত্বের অন্যতম সহায়ক ধাপ।
এ অবস্থায় মা ও সন্তান দুজনের জীবনেই প্রবল ঝুঁকি থাকে। গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যা দুটি আরেক মহামারি। সন্তান প্রসবের সময় সাধারণত প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন প্রসূতিকে হাসপাতালে নিতে চায় না। আবার নিলেও অনেকে প্রশ্ন তোলে পুরুষ ডাক্তার মহিলাদের সন্তান প্রসব করাবে কেন? অথচ এ শ্রেণিই কিন্তু মেয়েদের উচ্চশিক্ষার রাস্তা বন্ধ করে বিবাহের ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লাগেন। সেক্ষেত্রে মহিলা ডাক্তার আসবে কোত্থেকে?
সরকারেরও কর্তব্য নারী শিক্ষার্থীদের মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোতে অধিক হারে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে এ ব্যাপারে নিয়মকানুন সহজতর করা।
যাহোক, শুরু করেছিলাম করোনাকালে সহস্রাধিক মেয়ের বাল্যবিবাহ নিয়ে। আসলে এটা নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নয়। এতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, এখন খুলছে। পত্রিকায় বের হচ্ছে যেসব প্রতিবেদন তাতে দেখা যায়, শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকছে। এর মধ্যে কজন নারী আর কজন পুরুষ তা নির্ধারিত হয়নি। বিষয়টি সঠিকভাবে সরকারি উদ্যোগে উপস্থাপন হওয়া বাঞ্ছনীয়। যদি নারী-পুরুষ সমান সমানও হয় তবে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে সে সংখ্যা তো ২০-৩০ লাখের কম নয়। এর মধ্যে যদি শতকরা ২৫-৩০ ভাগও বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে থাকে তবে সে সংখ্যা অবশ্যই আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ বলা যায় আর্থিক দৈন্য। এ সংকট করোনা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। সমস্যাটি দীর্ঘদিনের পুরোনো তা কর্তৃপক্ষেরও অজানা নয়।
সব মিলিয়ে নারীর মেডিক্যাল শিক্ষায় অগ্রাধিকার দান, গ্রামাঞ্চলে বাধ্যতামূলকভাবে নারী গাইনি ডাক্তার নিয়োগ, হাসপাতালের সংখ্যা ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রসবের অন্তত ২ সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি বাধ্যতামূলক করাসহ শিশু জন্মের মুহূর্তেই তার নাম, মা-বাবার নাম, ঠিকানা ও জন্মতারিখ ও সময় লিপিবদ্ধ করে তা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রেরণ বাধ্যতামূলক করা দরকার।
শিশুর বয়স ৫ বছর পূর্ণ হতেই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করাও বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এতে বহু সমস্যার সমাধান হবে। নারীশিক্ষার অধিকতর প্রসার এ ব্যাপারে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। বাল্যবিবাহ রোধেও এ ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া দ্রুত দেশের সর্বস্তরে টিকার ব্যবস্থা করাও একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। কেননা, মৃত্যুহার কমলে বাল্যবিবাহও কমে আসতে থাকবে।
এ প্রস্তাবগুলোর সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে করোনা সংক্রমণ, মৃত্যু, বাল্যবিবাহ, অকাল মাতৃত্ব ও বৈধব্য হ্রাস। তবে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর যে অভাব দেশের সর্বত্র রয়েছে তা দূর করতে নতুন মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৫০ থেকে ৫ শ, ৫শ’ থেকে হাজার শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা অপরিহার্য।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক