বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়

  • নাসির আহমেদ   
  • ৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৮:২৯

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে। বিচারপতি ফজলুল হকের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাও এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। লাখো শহিদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিরাও নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের উপদেষ্টার আসন অলংকৃত করেন! সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোহমুক্তি ঘটাই স্বাভাবিক।

বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনও প্রায় ২ বছরের দূরত্বে। কিন্তু সে নির্বাচন নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। তাতে সবচে বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। বলা যায়, আবারও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠে এসেছে।

বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিবসহ দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অংশগ্রহণ না করার কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই উচ্চারণ করছেন। দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সভা-সমিতিতে যেমন, তেমনি গণমাধ্যমের কাছেও একই দাবির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েকমাস। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি তোলে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে, এত স্বল্প সময়ে আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠন অসম্ভব। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি নাকচ করে দেয়। এক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একটি সুপারিশের কথা গুরুত্ব পেতে পারে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা।

বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থান দেখে অনেকেরই মনে পড়বে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬-এর কথা। মাগুরা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়- নির্বাচন কমিশনের প্রতি তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকারের কাছে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ ছোট-বড় সব দলের দাবি ছিল নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।

ক্ষমতাসীন বিএনপি তখন অনড় ছিল দাবি না মানার ব্যাপারে। সেদিন সে দাবিকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘অসাংবিধানিক ও অবাস্তব’ বলে মন্তব্য করেন।

তীব্র আন্দোলনের মধ্যে ১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদে বিল আনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সে বিল পাস করেনি ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সংঘাত ছিল আসন্ন।

সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সৃষ্ট সেই সংঘাতমুখর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বিগ্ন ছিল। কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান এসেও এর কোনো মীমাংসা করতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার সরকার গঠন করে, ২১ মার্চ ১৯৯৬ জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন ও ২৬ মার্চ সে বিল পাস হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়।

সুপ্রিম কোর্টের সেসময়ের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তিনমাস মেয়াদের একটি সরকার গঠিত হয় এবং সেই সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, সাংবিধানিকভাবে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অস্থায়ী সরকার প্রধান করে ১৯৯১-এর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পুনরায় তার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যান। এ অসাধ্য সাধন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই।

১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর ভূমিকা মোটেও অবিতর্কিত ছিল না। বিশেষ করে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়ামী লীগবিদ্বেষী ভূমিকা এবং রাষ্ট্রপতির পদে থেকে একসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাটিকে চরমভাবে বিতর্কিত করে যান।

কথায় বলে, ‘কম ধাওয়া খেলে বিড়াল গাছে ওঠে না’। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন, তার পেছনে এরকম অনেক যৌক্তিক কারণ নিহিত ছিল। সংসদে পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের ৫৮(ক) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত এবং ২(ক) পরিচ্ছদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করা হয়।

বেগম খালেদা জিয়া যে বলেছিলেন, ‘শিশু এবং পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়’- কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। দলীয় সরকারের রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব দিলে কী অবস্থা হয় সেটা ২০০৭-এ প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। ইয়াজউদ্দিন সরকারের তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে ড. আকবর আলি খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, সি এম শফি সামি ও সুলতানা কামালের মতো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন বিজ্ঞ উপদেষ্টারা সরকারপ্রধানের তুঘলকি কাণ্ড দেখে পদত্যাগ করেন! এসব কাণ্ড ও সংঘাতমুখর পরিস্থিতি দেখে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং ইয়াজউদ্দিনকে পদত্যাগে বাধ্য করে, জারি করা হয় জরুরি অবস্থা।

সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বানিয়ে ৩ মাসের জায়গায় ২ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখা যে অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে, তাতে কেউ আর ও পথে পা বাড়াবে বলে মনে হয়নি।

অতীতের এসব কথার উল্লেখ এজন্য যে, সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ২০০১-এ বিচারপতি লতিফুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগের পর তার উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগের আগে তিনি যেভাবে প্রশাসন ব্যবস্থা তছনছ করে ফেলেন, তা কারো অজানা নয়!

সরকার গঠনের আগে সরকার পরিচালনা বৈধও নয়। শুধু তাই নয় তিনটি মাসের কর্মকাণ্ডে তার পক্ষপাতদুষ্টতা আজও দেশের প্রধান দৈনিকগুলোর পুরোনো ফাইল পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ অবলোকন করতে পারে।

আসলে একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সততাই যথেষ্ট। কমিশনের যে ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে দেয়া আছে, তারা যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং দলমতের ঊর্ধ্বে থাকার প্রত্যয় পোষণ করে- নিশ্চিত করে বলা যায় ভারতের টি এন সেশনের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার না হলেও যেকোনো সিইসি দক্ষতার সঙ্গে একটি চমৎকার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে।

একথা কে না জানে, সাংবিধানিক এ পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, চাইলেই তাদের বহিষ্কার ও কাজে হস্তক্ষেপ করা যায় না। সরকার হস্তক্ষেপ করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি তা না মানেন তাহলে সরকারের কিছুই করার থাকে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত সবকিছুই পরিচালিত হবে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী।

এতো ক্ষমতার অধিকারী হয়েও দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনের প্রধানদের কেউ এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, যা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে উচ্চমানে নিয়ে যেতে পারে।

ডক্টর সি এম শফি সামির একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সংকট আমলাতন্ত্রের।’ তার এ উক্তি প্রসারিত করা যায়, গভীর ব্যাখ্যাও দেয়া যায়! আমলারা তো রাষ্ট্রের তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, একটি সরকার মাত্র পাঁচ বছরের কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত।

সরকার বদলের সঙ্গে তারাও যদি দল বদল করে ফেলে, তাহলে সে সংকটের কথাই মনে পড়বে। কুইনাইন জ্বর সারবে বটে কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে। বিচারপতি ফজলুল হকের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাও এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। লাখো শহিদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী ব্যক্তিরাও নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের উপদেষ্টার আসন অলংকৃত করেন! সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোহমুক্তি ঘটাই স্বাভাবিক।

আমাদের প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তা যেকোনো সরকারের অধীনেই হতে পারে যদি নির্বাচন কমিশন সঠিক আচরণ করে এবং আমলাতন্ত্র তথা প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠানে আন্তরিক হয়।

আমরা আশা করতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আর কোনো সংঘাত নয়, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যা কিছু করণীয় সে বিষয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এক প্ল্যাটফর্মে এসে একটি সমাধানের পথ উদ্ভাবন করবে। নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে, সে কমিশনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চমানের নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক।

যে কথা আগেই বলেছি, নির্বাচন কমিশন যেন সত্যিকারের নির্বাচন কমিশনের মর্যাদায় নিজেদের ভূষিত করে। যাতে নির্বাচনকালীন শক্তিশালী সরকারের মতো ভূমিকা তাদের হাতে থাকে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছুই তো কমিশনের অধীনে থাকে। প্রয়োজন কেবল সততা ও সৎ সাহসের সঙ্গে নিজেদের উজ্জ্বল ভূমিকাটি জাতির সামনে উন্মোচন করা। আশা করতে চাই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন দেশবাসীর সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের সংকল্প নিয়ে এ দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর