বেশ কবছর আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় আমার লেখা কলামের শিরোনাম ছিলো- ‘আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা ক্যাশ করতে পারছে না’। দেশের রাজনীতি মোটামোটি ৫০ বছরের অধিক সময় কম বেশি পর্যবেক্ষণ করে আসছি, প্রায় ৪০ বছর ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার লেখা পর্যবেক্ষণগুলো ছাপাও হচ্ছে।
এখনও গ্রামের খোঁজখবর যতটুকু রাখি, বিভিন্ন অঞ্চলের পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে যে চিত্রটি পাচ্ছি তাতে গ্রামাঞ্চল থেকে উপজেলা, জেলা পর্যন্ত অনেক জায়গাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনে কুণ্ঠাবোধ না করলেও তার নির্দেশনা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সব ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নিজেকে দেশ ও জাতির কল্যাণে সমর্পণ করে দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে যেভাবে কাজ করছেন, জীবনযাপন করছেন এবং লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুর মতো সহজ-সরল সাদাসিধে জীবন যাপনের যেসব বক্তব্য তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রায়ই দিয়ে থাকেন, তার সেসব কথা ও পরামর্শ যদি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সবাই অনুসরণ করত তাহলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যে জনভিত্তি এতদিনে দাঁড়িয়ে যেত, সেটি ভাঙতে কেনো রাজনৈতিক অপশক্তির পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব হতো না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেকেই দল করে, মুখে বলে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা আছে, প্রয়োজনে যেকোনো ঝুঁকি কাঁধে তুলে নিতে রাজি আছে, বাস্তবে কত শতাংশ নেতা ও কর্মীর এসব প্রতিশ্রুতির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে সেটি বোধ হয় এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক, সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রায়ই দলের যেসব নেতাকর্মী দলের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ভোগবাদিতা, অর্থ-বিত্ত, পদ-পদবি ইত্যাদির পেছনে দৌড়াচ্ছে তাদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তাতে তাকে দর্শক-শ্রোতাদের হাততালি পেতে দেখি। কিন্তু যারা হাততালি দিচ্ছেন তাদের সবাই কি দলের স্বার্থে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে পেরেছেন? গ্রামগঞ্জে এখন অনেক তরুণ যুবককে দেখি যারা হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ বা তাঁতি লীগের নেতা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে, দল বা অঙ্গসংগঠনে পদ না পেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো না কোনো কমিটি বাগিয়ে নেয়ার জন্য জান দিয়ে ফেলে। অথচ এদের শিক্ষাগত তেমন কোনো যোগ্যতাই নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইন, বিধিবিধান কী তাও জানে না।
তাছাড়া গ্রাম এলাকায় নানাজনের নানা বিষয় নিয়ে তদবির করা, আচার বিচার করা, সামাজিকতার নামে ব্যক্তিজীবনে প্রভাব বিস্তার করা, ব্যবসা-বাণিজ্য পাতিয়ে রাতারাতি বড়লোক বনে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। স্থানীয় থানা পুলিশ নানা ধরনের অফিস, ঠিকাদারি ইত্যাদি বাগিয়ে কেউ কেউ বেশ অর্থকড়িও করে ফেলেছে। কিন্তু এদের কাউকেই এলাকায় বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার জীবন ও রাজনীতি নিয়ে কোনো ধরনের সাংগঠনিক কাজ করতে, জনগণের মাঝে রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে খুব একটা যুক্ত আছেন বলে এলাকার কেউ বলছে না।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কারো কারো ভালো সম্পর্ক, কারো কারো আবার বিরোধ চরম পর্যায়ে। গ্রুপিং প্রায় সবর্ত্রই জানাজানি হয়ে আছে। কোনো একটি নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই সবাই প্রার্থী হতে চায়। জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে কি নেই সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও প্রয়োজন মনে করে না। দল যদি মনোনয়ন না দেয় তাহলে বিদ্রোহীপ্রার্থী হতে মোটেও দেরি করেন না। এটি গ্রাম থেকে উপজেলা এবং জেলাপর্যায়ে এখন যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি প্রমাণ করে না যে, এরা দলের আদর্শ মেনে চলে, নেত্রীর নির্দেশনা অন্তর থেকে মেনে চলে। অনেক এলাকাতেই এখন বাহ্যিকভাবে অনেককেই আওয়ামী লীগ করতে দেখা যায়। কিন্তু জনগণের কাছে তাদের কজনার প্রতি আস্থা আছে সেটি তলিয়ে দেখার বিষয়।
সমাজে যদিও রাজনৈতিক মেরুকরণ বেশ ঘটে গেছে, তারপরও অনেক মানুষ আছেন যারা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধা করেন, তার কাজকর্ম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অনেকেই আছেন যারা সরকারি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, আবার অনেকেই স্থানীয় তথাকথিত নেতাদের কারণে সরকারি বেশ কিছু সাহায্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ও সহযোগিতা, আর্থিক সহযোগিতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ‘নেতাকর্মীদের’ নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এই মানুষগুলো শেখ হাসিনাকে ভালোবাসছেন, কিন্তু স্থানীয় ওইসব তথাকথিত নেতাদের মনে মনে ঘৃণা করছেন, তাদেরকে এড়িয়ে চলছেন। অনেক সময় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে কিছু বলছেন না। এই ধরনের পরিস্থিতি একেবারেই কম নয়। সব জায়গায় আছে তা বলছি না। তবে স্থানীয় পর্যায়ে দলের নাম ভাঙিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করছে, যা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ায় না।
এটি যে একেবারে গ্রামপর্যায়ে সীমাবদ্ধ আছে তা নয়। উপজেলা কিংবা সংসদীয় আসনগুলোর বেশ কয়েক জায়গায় এক ধরনের নীরবতা জনসাধারণের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। স্থানীয় এসব নেতাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ কতটা সন্তুষ্ট তা একান্তে কথা বললেই বোঝা যায়। বেশ কিছু সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা মেয়র বা গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য পদে থাকা নেতার জনপ্রিয়তা এলাকায় খোঁজ নিলেই কানে ভেসে আসে। কিন্তু অনেকের বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। এমনকি দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা নানা হতাশায় ভুগছেন। আসলে দলের কিংবা জনপ্রতিনিধিত্বের আসনে যারা আছেন তাদের সম্পর্কে দলকে পক্ষপাতহীনভাবে খোঁজখবর ও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যারা দলের জন্য প্রশংসা কুড়াতে পারেননি তাদের দলে প্রয়োজন কী? তাদেরকে নির্বাচনে দাঁড় করালে খুব একটা লাভ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন, কিন্তু এলাকায় তার পদচারণা খুব একটা পড়ে না। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও খুব বেশি দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ আছেন থাকেন ঢাকায়, নিজের একজন অনুগত অথবা আত্মীয়কে এলাকায় দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। আত্মীয়-স্বজনরা দলকে কতটা সুনাম কুড়িয়ে দিতে পারছেন সেটি বোধ হয় এখন তলিয়ে দেখার সময় হয়েছে। এদের সঙ্গে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দূরত্ব, বৈরিতা যেমন বেড়েছে, তেমন দলের কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দলের পরিচয়ে যারা উপজেলা কিংবা নির্বাচনি আসনে তেমন কোনো সংযোগ-যোগাযোগ রাখেন না তাদের কারণে দলের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধির কোনো সুযোগই ঘটেনি।
দলীয় কোনো কর্মসূচি নেই, সভা-সমাবেশও বলতে গেলে অনেক জায়গায়ই নেই। সাধারণ মানুষ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান সময়ে রাজনীতির সঙ্গে আশপাশে থাকা জড়িতদের কর্মকাণ্ড, আচার আচরণ, বিত্তশালী হয়ে ওঠার প্রবণতা ইত্যাদি দেখে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তবে এমন অনাগ্রহের জায়গায় অনেকের অলক্ষ্যে চলে যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক নানা গোষ্ঠীর কিছু নারী ও পুরুষ যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার এবং দ্বীন ও ধর্মের পথে মুক্তির সন্ধানের দাওয়াত দিয়ে বেড়াচ্ছে। বিষয়টি গোপনে হলেও গ্রামগঞ্জে সর্বত্র চলছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাদের ব্যস্ততা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার মধ্যেই। যারা আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী তারা নানা হতাশা ব্যক্ত করছেন। কিন্তু পেরে ওঠার মতো অবস্থা অনেকেরই নেই। সুতরাং ভালো-মন্দয় মিলে যা দেখছি তা থেকে মন্দকে প্রতিহত করা, ভালোকে সামনে নিয়ে আসা এখন আওয়ামী লীগের জন্য একান্তই অপরিহার্য।
আওয়ামী লীগের মোটেও প্রয়োজন নেই ওইসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যাদের দায়দেনা দলের জন্য ক্ষতিকর, বরং তাদেরকে দল থেকে সরিয়ে দিলে জনগণই সবচাইতে বেশি খুশি হবে। জনগণ দলের সভাপতি শেখ হাসিনার মধ্যে যে রাজনৈতিক দৃঢ়তা, জনকল্যাণবাদী চিন্তা, সততা, নিষ্ঠা এবং দেশকে সমৃদ্ধির যাত্রায় অনেক ঊর্ধ্বে তুলে আনার চেষ্টা দেখছে তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি কায়মানোবাক্যে প্রার্থনা করে। কিন্তু তৃণমূলের মূলখোর নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুব একটা দেখতে চায় না।
শেখ হাসিনা যতই এদেরকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন ততই তার ভিত্তি জনগণের কাছে আরও শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে যদি এরা এভাবেই থাকে তাহলে নেত্রীর প্রার্থী পরিচয়ে অনেকেরই ভোটপ্রাপ্তি খুব একটা ঘটবে না। রাজনীতির এই বাস্তবতাটি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে, সেভাবেই সামনের সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে। তাহলেই কোনো ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হওয়া ছাড়া সাফল্যের মুখ দেখবে না।
লেখক: অধ্যাপক-গবেষক।