যে কবিগুরুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, তার চুল তো লম্বাই ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা... অনেক কবি সাহিত্যিকই লম্বা চুলের অধিকারী। আবার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, আ্যালেন গিন্সবার্গ, কোলরিজ, জন মিল্টনের মতো সাহিত্যিকের চুলও লম্বা। প্লেটো, এরিস্টটল, রুশোর চুলও কিন্তু নেহায়েত খাটো ছিল না। লম্বা চুলের মালিক ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, স্যার আইজাক নিউটন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, মাইকেল ফ্যারাডে, আর্কিমিডিসও। অপরদিকে খাটো চুলের পাল্লাটাই বেশি ভারী।
বড় বা ছোট, ঘন বা পাতলা, সাদা বা কালো, খাটো বা লম্বা, টাক বা মাথা ভর্তি চুল কোনো সমস্যা নয়। এটি যার যার ব্যক্তিগত অভিরুচি। এটি আলোচনারও কোনো বিষয় নয়। কিন্তু যেটি বিষয় তা হলো- ভদ্রতা, শালীনতা, শিষ্টাচার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আত্মসম্মানবোধের।
সম্প্রতি এমনই এক বিষয় নিয়ে নজিরবিহীন এবং ন্যক্কারজনক ঘটনার নজির দেখিয়েছেন সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন। শুধু সহকারী প্রক্টরই নন, তিনি সেখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানও।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বরাতে গণমাধ্যম থেকে জানা গিয়েছে, গত রবিবার দুপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় ওই বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন আগে থেকেই কাঁচি হাতে হলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীরা প্রবেশের সময় ধরে ধরে ১৪ ছাত্রের চুল কেটে দেন।
সবার সামনে এভাবে তাদের লাঞ্ছিত করার পর ওই শিক্ষক জোর করে তাদের পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছেন। শিক্ষার্থীদের পরিবার তুলে গালিগালাজও করেছেন। ছাত্রদের বক্তব্যের সত্যতা ভিডিও ফুটেজেও নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। ওই শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে কারণে-অকারণে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চরম অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন।
পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এই শিক্ষক। এর শোধ তিনি নিয়েছেন পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের চুল কেটে । এতে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অপমান সইতে না পেরে এক শিক্ষার্থী ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে যেয়ে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি আছেন খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে কয়েকটি দায়িত্ব থেকে ফারহানা ইয়াসমিনকে। বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বোর্ডের সদস্য- এই তিনটি পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বোর্ড। তবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলেও স্থায়ীভাবে অপসারণ না করায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
এসবের জেরে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এমন এক অযোগ্য মানুষকে পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়নের মতো বিষয়সমূহ, যে কি না সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ন্যূনতম ধারক-বাহক নয়। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি বিচার করার ক্ষমতাও নেই। ফারহানা ইয়াসমিন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। তাকে নিয়োগ দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি সাধনে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নয়ন এবং বাঙালি জাতির মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের নামানুসারেই ২০১৫ সালে তার স্মৃতিধন্য শাহজাদপুরে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। আশা করা হয় সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে এর ক্যাম্পাস। কিন্তু ফারহানা ইয়াসমিনদের মতো শিক্ষকদের কারণে সেই আশার গুড়ে বালি পড়বে নিঃসন্দেহে।
বর্তমানে শিক্ষার যে ধরন, তা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও যান্ত্রিক করে তুলছে। সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের কোনো ভাবনা নেই। আসলে ভাবনার জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষাব্যবস্থার কোনো স্তরেই সেটি নেই। পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিই মুখ্য। সামষ্টিক অংশগ্রহণে উন্নততর মানস গঠনে এখন সকলের ভূমিকাই গৌণ।
আমরা এমন একটা সমাজে বাস করছি যেখানে আত্মসর্বস্ব ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা গ্রাস করেছে সর্বত্র। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষেরই একই অবস্থা। এই অবক্ষয়ের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়তই জানিয়ে দিচ্ছে কতটা অধঃপতিত হচ্ছি আমরা। তাই তো ফারহানার মতো শিক্ষকের এমন কাজে বিবেক বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
শুধু রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ফারহানাই যে এমন তা নয়; গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন অসংখ্য ফারহানার দেখা পাওয়া যেতে পারে। যারা কারণে-অকারণে শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করে, পীড়ন করে, অপমান-অপদস্ত করে। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি করে নিগ্রহের শিকার হয় তাদের পোশাকের কারণে।
দেশে পোশাক নিয়ে এখন দুই ধরনের ট্রেন্ড চলছে। এক, পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাক। দুই, মধ্যপ্রাচ্য ঘরানার পোশাক। অভিজাত শ্রেণি হওয়ায় পাশ্চাত্য ঘরানা নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করার সুযোগ না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য ঘরানা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল। আশি-নব্বইয়ের দশকে এ দেশের স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে অল্পকিছু পেট্রো-ডলারের সঙ্গে বেশি করে পোশাকের কনসেপ্ট নিয়ে এসেছে।
যা ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার মাঝে। যার সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র খুব অল্পই। এসব পোশাক প্রদর্শনের খুব বড় জায়গা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং উৎসাহ দিতে অথবা বাধ্য করতে শিক্ষিকাদের বিশেষ ভূমিকা লক্ষ করা যায়। স্কুল-কলেজগুলোতে পরিপূর্ণ নাগরিক হওয়ার লক্ষ্যে মানস গঠনের পরিবর্তে খুব বাহ্যিক, স্থূল বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া হয় বেশি। ফলে পদে পদে ধাক্কা খাচ্ছি আমরা। আমাদের স্বকীয়তা, নিজস্বতা প্রায় হারিয়েই ফেলেছি।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনার।যতদিন ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে জিপিএ ফাইভ বেশি কাঙ্ক্ষিত হবে, নিজের চিন্তা-চেতনায় গভীরতা আসবে না, বিসিএস সবচেয়ে বনেদি চাকরি হবে, যেকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনই জীবন ধারণের একমাত্র নিয়ামক হবে, নিজের সংস্কৃতি নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগবে, ন্যায়-অন্যায়ের ভেদাভেদ করার ক্ষমতা তৈরি হবে না; ততদিনই আমরা দেখতে থাকব ফারহানাদের অশোভন কর্মকাণ্ড।
সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের যে বৃক্ষটি ফুল ফলে শোভিত ছিল, ছায়া দিত পথ চলতি মানুষদের, নিঃস্বার্থভাবে সবার অজান্তেই শোষণ করে নিত কার্বন, নির্মল সবুজের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিত সবার মাঝে; সে নিজেই আজ প্রায় সমূলে উৎপাটিত, স্থানচ্যুত, মৃতপ্রায়। তাই ফিরে যেতে হবে নিজের অস্তিত্বের কাছে, মাটির কাছে, সংস্কৃতির কাছে, মায়া খুঁজতে হবে নিজের কায়াতেই। তাহলেই হয়তো এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক