লেখার শুরুতেই জানাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ৭৫তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ক্রমেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য আরও অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। তাই তার শতায়ু কামনা মন থেকে আপনা আপনি চলে আসছে। তিনি প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে শুধু নয়, পিতার মতো বিশ্বের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনিও একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। নিজদেশে তিনি ফিরেছেন শূন্য হাতে। তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বাধা প্রদান করা হচ্ছিল।
জীবনের প্রতি আগে থেকেই হুমকি আসতে থাকে। যারা তার বিপক্ষে এভাবে অবস্থান নিয়েছিল তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা বঙ্গবন্ধু, মাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্য তিন ভাই, দুই ভাইয়ের নববিবাহিতা স্ত্রী, চাচা, নিকট আত্মীয়, শেখ মণি ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে।
সেই দিন যদি শেখ হাসিনা দেশে থাকতেন তাহলে তাকেও ঘাতকরা রেহাই দিত না। কারণ ওই হত্যাকাণ্ডটি ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকারকে সবংশে নির্মূল করা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব আদর্শের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত করা। তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল ঘাতকদের চারণভূমি এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবনের পথকে সুগম করার এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখা। সেই রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকার ফিরে আসা ছিল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৫ আগস্ট দেশে না থাকার কারণে হত্যার শিকার হননি। তবে তারা দেশে ফিরতে পারেননি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত করার মাধ্যমে দলকে পুনরুজ্জীবনের এক গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তটি দলের জন্যই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। কারণ সাধারণ মানুষ ৭৫-৮১ পর্যন্ত সময়ে দেখেছে দেশ কীভাবে সান্ধ্য আইনে চলে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিকে কীভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং রাজনীতির খুনি, ঘাতক, সুবিধাবাদী, ৭১-এর পরাজিত শক্তি এবং পাকিস্তানের ভাবাদর্শের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের প্রতি এর চাইতে বিশ্বাসঘাতকতা আর কী হতে পারে! বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কত সব কুৎসা, অপপ্রচার রটিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে তার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাষ্ট্রচেতনা থেকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করার এক নীলনকশা ও গভীর ষড়যন্ত্র স্বাধীনতার পর থেকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা অপশক্তি বাংলাদেশে সংগঠিত করে আসছিল। ফলে মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভোলেনি। যদিও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলকারীরা বঙ্গবন্ধুর নামটিও মুছে ফেলার সব শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছিল। এটি ছিল তাদের এক দীর্ঘ পরিকল্পনা। তারা নিশ্চিত ছিল বাংলাদেশ আর কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরবে না।
সেই পথ তারা ১৯৭৫ থেকে হত্যা ও রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে তৈরি করে যাচ্ছিল। স্বদম্ভে তারা উচ্চারণ করেছিল বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলবে না, রাষ্ট্রক্ষমতায়ও আর কোনোদিন কেউ আওয়ামী লীগকে দেখবে না। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা তেমনটি স্বদম্ভে উচ্চারণ করত। বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরে আসার পদে পদে ছিল হত্যার হুমকি, বাধা-বিপত্তি। সহজেই অনুমেয় ছিল বাংলাদেশকে তারা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশ মনে হয় কেবল তখন স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্যই নিরাপদ ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের হত্যা করা হলো, তাদের অনুসারীদের জেলে নিক্ষেপ করা হলো, রাজনীতি তাদের জন্য জটিল করে দেয়া হলো। এমন বাস্তবতায় শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা, রাজনীতিকে আবার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার কাজটি ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকায় অবতরণ করার পর বোঝা গেল বাংলাদেশ শেখ হাসিনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিল সেটির বহিঃপ্রকাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছিল। তিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। ঢাকায় তার থাকার ছিল না একটি ঘর। যদিও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি একসময় ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির সবচাইতে আলোচিত এবং উদারভাবে আশ্রয় নেয়ার স্থল।
এই বাড়িটি শেখ হাসিনার পৈতৃক বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেখানে উঠতে দেয়া হয়নি। সেখান থেকেই তার রাজনীতিতে হাঁটিহাঁটিপা চলা। তিনি কোনোদিন ভাবেননি তাকে রাজনীতিতে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুও তাকে রাজনীতির উত্তরাধিকার হিসেবে আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখেননি। যদিও তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কঠিন সংগ্রামী জীবন ও দর্শনের ভেতর দিয়েই বড় হয়েই উঠছিলেন।
১৯৪৭ সালে আজকের এই দিনে টুঙ্গিপাড়ায় যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার পিতা যুবনেতা শেখ মুজিব ঢাকায় নতুন আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এর আগে পাকিস্তানের জন্য মুজিব ঢাকায় ফিরে এসেই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়। সেকারণে তিনি ঢাকার রাজনীতিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অতি পরিচিত এবং অপরিহার্য হয়ে উঠছিলেন। তার তখন টুঙ্গিপাড়ায় যখন তখন যাওয়ার সময় ছিল না। ঢাকায়ও তার কোনো থাকার নিবাস ছিল না। রাজনীতির কারণে তাকে কারাগারে যেতে হয়। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ২ বছর ১ মাস ২৭ দিন তিনি ছিলেন ঢাকা ও ফরিদপুরের কারাগারে।
সুতরাং এহেনও মুজিবের কন্যা, শিশু সন্তানরা তাকে কাছে পাবেন, একসঙ্গে থাকবেন এমনটি তো আশা করা যায় না। তার পরও টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের কন্যা, প্রথম পুত্র কামাল মা ও দাদা-দাদির আদরেই বড় হচ্ছিলেন। পিতাকে তারা দেখেছেন খুবই কম। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অসুস্থ পিতাকে কিছুদিন টুঙ্গিপাড়ায় দেখতে পান। কিন্তু সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার তিনি ঢাকায় চলে এলেন। রাজনীতির উত্তাল ঢেউ সৃষ্টিতে মুজিব ছাড়া যেন চলছিল না। ১৯৫২-৫৩ সালে সেই ঢেউই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এর পরই কেবল তাদের ঢাকায় আসা। ১৯৫৪ সালে ঢাকার টিকাটুলিতে ভাড়া বাসায় তারা উঠলেন।
যদিও তিনি টুঙ্গিপাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন। তবে ঢাকায় আসার কারণে ভর্তি হলেন নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। এরপর রাজনীতির উত্থান-পতন এই প্রদেশে যতবার ঘটছিল, ততবার মুজিব পরিবারের ওপর দিয়েই ঝড়টি যেন বার বার বয়ে যাচ্ছিল। বেগম মুজিব সন্তানদের আগলে রাখার জন্য সকল শক্তি নিয়োগ করেন। সন্তানদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা যাতে নির্বিঘ্ন থাকে সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেন।
১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি তৈরি হলে এখানেই মুজিব পরিবার স্থির হওয়ার সুযোগ পায়। শেখ হাসিনা তখন আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলে চলে আসেন। ১৯৬৫ সালে এখান থেকে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন বকশীবাজারের ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে।১৯৬৭ সালে তিনি আইএ পাস করেন। কলেজে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬ দফার আন্দোলনে তখন তিনি জড়িয়ে পড়েন। পিতা বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি ভর্তি হন। ওই বছরটিতে পিতার ইচ্ছাতে ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শেখ হাসিনা পিতা ও স্বামীর সংসারে সদস্য হয়েও সেই উত্তাল দিনগুলোতে স্বামীর সঙ্গে রাজনীতির মাঠে নিজেকে যুক্ত রাখেন তবে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে গেল তখন বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বেগম মুজিবসহ পরিবারের সদস্যদের ধানমন্ডির একটি বাসায় বন্দি করে রাখা হয়। এখানেই যুদ্ধ চলাকালে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়।
যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অনুসারী ও পর্যবেক্ষক ছিলেন। কিন্তু তিনি কিংবা বঙ্গবন্ধু কেউই স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জীবন এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সেটি কল্পনা করতে পারেননি। সে অনিশ্চয়তার পথ কত নির্দয়, নিষ্ঠুর, রক্তাক্ত এবং প্রতিশোধে পূর্ণ সেটি ১৫ আগস্ট থেকে এখন অবধি বদলায়নি। এমন এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতির হাল ধরলেন, নিজেকে সমর্পিত করে দিলেন পিতার মতোই। আর সেই কারণেই ৭৫-এর পর ঘুরে যাওয়া বাংলাদেশটিকে আবার ফিরিয়ে আনা শুরু করলেন অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায়।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে এসে তিনি ঘাতকদের সকল দম্ভ, ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন। আওয়ামী লীগ দেশকে যা দিতে পারে তা আগের কোনো সরকারই দেয়নি বা দিতে পারেনি সেটি প্রথম মেয়াদেই প্রমাণ করে দিলেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় নিয়ে আসলেন, এর গতিপথও যেন ফিরে পেল আপন ঠিকানা। এরপর ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি প্রমাণ করলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ করার কারিগর। সেই লক্ষ্যেই তিনি গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন, কৃষির উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপ্লবাত্মক ঘটনা সংগঠিত করা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, দারিদ্র্য বিমোচন করা, আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দেয়া।
শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনা। যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, কূটনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, আন্ত রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ইত্যাদি; আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রনীতিক ব্যবস্থায় তিনি যুগান্তকারী পরিবর্তন একের পর এক ঘটাতে থাকেন।
এখানেই তিনি অন্য সরকারগুলোর চাইতে নিজেকে আলাদা, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উন্নত মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার একজন ভিশনারি-মিশনারি রাজনীতিক রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে দেশ এবং বিদেশে প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশে এখনও অনেক অর্জনের বাকি, সেই অর্জনও সম্ভব হতে পারে কেবল তার কিংবা তার মতো নিঃস্বার্থভাবে সমর্থনকারী রাজনীতিবিদের মাধ্যমে যিনি বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের ফলগুধারা বহন করেন।
শেখ হাসিনার জন্মদিনে তাই কোটি কোটি মানুষের প্রার্থনা হবে বাংলাদেশ যেন আর কোনোদিন ঘাতকদের রাজনীতিতে ফিরে না যায়, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী অসমাপ্ত পথচলা। তাহলেই বাংলাদেশ ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি সফল হতে দেখবে।
লেখক: অধ্যাপক-গবেষক।