জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের খুনিরা দম্ভ করেই খুনের দায় স্বীকার করেছিল। এটাও বলেছিল- সাহস থাকলে কেউ বিচার করুক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেক সংবাদপত্রে সৈয়দ ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের পেছনে তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে নেয়ার পাশাপাশি কাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা পেয়েছে সেটাও জানিয়ে দিয়েছে।
জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের নারী-শিশুসহ সব সদস্যকে হত্যার পরও যে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না, তার আইনি নিশ্চয়তা মিলেছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণকারী খন্দকার মোশতাক আহমদ খুনিদের বিচার করা যাবে না ২৬ সেপ্টেম্বর (১৯৭৫) ‘সামরিক আইনবলে’ পাওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ অধ্যাদেশ জারি করেন। পরে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদকে কাজে লাগিয়ে তার অনুমোদন দেন।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইসনমেনিটি আইন বাতিল করে। ফলে ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারের আইনি বাধা দূর হয় এবং আদালত বিচারকাজ শুরু করতে পারে। সংগত কারণই প্রশ্ন উঠছে- বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের বিচার হতে পারলে এ ভয়ংকর অপরাধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দিয়েছে এবং তাদের রক্ষার রক্ষার জন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করেছে তাদের কেন বিচারের আওতায় আনা হবে না?
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েছেন, সন্দেহ নেই। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন এবং ২৯ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। এ জন্য কোনো নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি, সামরিক আইনের ঘোষণাই যথেষ্ট ছিল।
আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ৮ জুন কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদ সভায় সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আগে গুরুত্বপূর্ণ একটি কার্য সম্পাদন করেন- সামরিক শাসন জারির পর যত অধ্যাদেশ, বিধিবিধান ও নির্দেশ জারি করেছেন- সবকিছু সংবিধান ও আইনসম্মত হিসেবে অনুমোদনলাভ।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মতোই একটি কাজ করেছেন ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সে দিন জাতীয় পরিষদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল অনুমোদিত হয়। আমাদের জানা আছে, জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী পদে নিয়োগদান করেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি খন্দকার মোশতাক আহমদ। জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান।
বঙ্গবন্ধুকে স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ নিষ্ঠুরভাবে বাসভবনে হত্যা করা হয়। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাংলাদেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। একইদিনে আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণিসহ আরও কয়েকজনকে ঘাতকরা হত্যা করে। এসব খুনে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা দম্ভ করে বলছিল- তারাই ‘শেখ মুজিবকে সবংশে হত্যা করেছে।’ খুনিরা এটাও বলত- জিয়াউর রহমান বরাবর তাদের সঙ্গেই মুজিবহত্যার চক্রান্তে জড়িত ছিলেন।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্র ক্ষমতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। যদিও কাগজে-কলমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, কিন্তু ক্ষমতার দণ্ড ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি গ্রন্থে লিখেছেন-
“১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দেন। রাষ্ট্র্রপতির পদ ছেড়ে দেন কয়েক মাস পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল।” [পৃষ্ঠা ৩৫]
তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমান যে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে অংশ নেবেন, সে ধারণা তিনি করতে পারেননি। [পৃষ্ঠা ৩৬]
কুটিল পথে সেনাবাহিনীপ্রধান চলেছেন, এটা বুঝতে পারেননি প্রধান বিচারপতি পদে থাকা আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, এটা ভাবা যায়!
ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পথে জিয়াউর রহমান একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সামরিক আইন বলবৎ রয়েছে। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা জেলে। জয় বাংলা উচ্চারণ করলেই জেল। বঙ্গবন্ধুর নাম এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৫ আগস্ট থেকেই। সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। এমন পরিবেশেই জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে ‘বিপুলভোটে নির্বাচিত’ হয়ে যান।
এর আগে তিনি আরেকটি কাজ করেন- সংবিধান সংশোধন। ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যায়। সমাজতন্ত্র বর্জন করা হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রত্যক্ষ সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। বাংলাদেশকে ফের ‘পাকিস্তান বানানোর’ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে তারা হয়ে ওঠে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগী।
১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রির জাতীয় সংসদে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী’ বিল ওঠে। এতে বলা হয়-
“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন ফরমান দ্বারা এই সংবিধানে যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে অথবা অনুরূপ কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা, বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, খুনিদের বিচার না করার কুখ্যাত বিধান- ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি প্রদান, জিয়াউর রহমানের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধন, গণভোটের প্রহসন- সব বৈধতা পায়।
বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুদের খুনিদের বিচার করা যাবে না- ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ বিধান জারি করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। তখন জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীপ্রধান। ক্ষমতা হাতের নাগালে, রাষ্ট্রপতির পদটি কখন হাতে আসবে- এমন ছক কষছিলেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি ও ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর সব অপরাধ হালাল করা হয়ে গেছে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর’ মাধ্যমে।
খুনিদের কেউ যেন কখনও বিচার করতে না পারে, সে জন্য ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটির অনুমোদন প্রদান করা হয়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে বিধান ছিল- খুনিদের দায়মুক্তি পেতে রাষ্ট্রপতি বা তার মনোনীত ব্যক্তির কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে হবে। জিয়াউর রহমান কেবল খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে আইন প্রণয়ন করেননি, নানা দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃতও করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের দাবি যতবার এসেছে- জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ এবং খালেদা জিয়া একই কথা বলে গেছেন- সংবিধান সংশোধন করতে হবে, দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে এই কুখ্যাত আইন জাতীয় সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই পাস হয়। সে সময় সংসদে বিএনপির সদস্যরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রস্তাবে সায় দেননি। কেনইবা দেবে? খুনিতে খুনিতে যে মিতালি!
২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের দণ্ড কার্যকর হওয়া শুরু হয়। তবে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কয়েকজন এখনও পলাতক। এদের ফিরিয়ে আনার দাবি জোরদার হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ যখন হাতে নেন- স্পষ্ট বলেছিলেন- প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই বিচারকাজ চলবে। সামরিক শাসনের আমলের মতো ধর-মার-কাট নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থমকে গিয়েছিল ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে। ঘাতকদের বিচার যেন না হয়, সে জন্য আইন প্রণীত হয়েছিল। এ কলঙ্ক মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এখন সময়ের দাবি- হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যুক্তদেরও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এমনকি এমন ঘৃণ্য অপরাধে অভিযুক্তরা বেঁচে না থাকলেও তাদের চিহ্নিত করা উচিত। অপরাধ করে রেহাই মেলে না- এটাও স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত