স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। ওই শতাব্দীর শুরুতে ১৯১৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পরিচয় করান। ৬ দশক পর বাঙালি জাতির মুক্তির নায়ক শেখ মুজিব জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে আবারও বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন।
এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৭৪) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। তখন চীন ভেটো দেয়া থেকে বিরত থাকে। ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ আনন্দ উল্লাস করে।
২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করেন। ওই সময় জাতিসংঘে ৬টি ভাষায় বক্তৃতা দেয়ার রেওয়াজ ছিল। এ ৬টির মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাভাষী এই নেতার বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুগ্ধ হন।
ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বিশ্বনেতারা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন ও আলিঙ্গন করেন। বাংলা ভাষা আসলে সেদিন থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা লাভ করে।
সৈয়দ আনোয়ারুল করিম জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন। ওই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। জাতিসংঘে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির একটি খসড়া তৈরি করে পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেসময়ের পদস্থ কর্মকর্তা ফারুক আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ভাষণ পাঠ শেষে প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে বলেন, “ভালোই তো তোমাদের ফরেন সার্ভিসের বক্তৃতা। কিন্তু তোমরা যে আসল কথাই লেখনি। দেশে বন্যা হয়ে গেল। দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে, সেই কথাটিই তো আমি জাতিসংঘে বলবার চাই। বাংলাদেশের সমস্যার কথা বিশ্ববাসী আমার মুখ থেকেই শুনুক। তোমাদের সংশয় কেন?”
সাঁটলিপিকার রোজারিওকে ডেকে আনা হলো। অদূরে সোফা দেখিয়ে ফারুক চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু বললেন, “ওখানে বসে আসন্ন খাদ্যাভাব সম্বন্ধে একটি লাইন তুমি আমার বক্তৃতায় জুড়ে দাও।”
পরবর্তী সময়ে ফারুক চৌধুরীর লেখা ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সফরের আগে পররাষ্ট্র সচিব একদিন বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রণয়নে সেসময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খুবই আগ্রহ দেখান। ঠাকুর এর আগে ইত্তেফাকের রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলা ভাষায় তার খুব দখল রয়েছে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলাতেই ভাষণ দেবেন, এটি জানার পর তাহের ঠাকুর বাংলায় ভাষণের একটি খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। পরে জানা যায়, তাহের ঠাকুরের ওই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি।
১৯৭৪ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দেয়া সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণের ইংরেজি অনুবাদটি পাঠ করেছিলেন ফারুক চৌধুরী।বঙ্গবন্ধু তার জীবনে সবসময় যা করেছেন, তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
এই যে বিশ্ব ফোরামে বঙ্গবন্ধু একদিকে বাংলা ভাষণ দিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফারুক চৌধুরী। আর এ জন্য নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন, তার কামরার রুদ্ধ কক্ষে প্রধানমন্ত্রী আর ফারুক চৌধুরীর মধ্যে বক্তৃতা পাঠের রিহার্সাল হয়েছিল অন্তত তিনবার।
এমনভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ফারুক চৌধুরী। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের খসড়াটিও লিখে দেন ফারুক চৌধুরী। ৯ জানুয়ারি দিল্লির অশোক হোটেলে লেখা সেই ছোট্ট বক্তৃতার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে-
“এই তাঁর জয়যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। ন’মাসের ব্যবধানে দেশে ফিরছেন তিনি। সেই সময়টুকুতেই আমার জনগণ শতাব্দী অতিক্রম করেছে, তিনি ফিরছেন বিজয়কে শান্তি, প্রগতি আর উন্নতির পথে চালিত করতে। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই সান্ত্বনায় যে অবশেষে অসত্যের ওপর সত্যের, উন্মাদনার ওপর প্রকৃতিস্থতার, কাপুরুষতার ওপর শৌর্যের, অবিচারের ওপর ন্যায়বিচারের, অমঙ্গলের ওপর মঙ্গলের হয়েছে জয়।” পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন- “ওতো আমার মনের কথাই লিখেছে।”
অবশেষে এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পিনপতন নীরবতার মধ্যে তার স্বভাবসুলভ সাবলীল ভাষায় দৃপ্তকণ্ঠে প্রথমেই বলেন-
“আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির অংশীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে- আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন। ইহা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেয়া হইয়াছে।”
আগামীদিনের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“...আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার ওপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংস, ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকার ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আনবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে। যে অর্থনৈতিক উত্তেজনা সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়াছে তাহা একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া জরুরিভাবে মোকাবিলা করিতে হইবে।”
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে ধ্বংসলীলার কথা উল্লেখ করে বলেন- “সাম্প্রতিক বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।”
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপোষ মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করেছি।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের জন্য যেসব পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেসব কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বলেন- “আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান রাখবে।”
পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“জনাব সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রেখে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতেছি। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের স্বনির্ভরতা।”
প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ন্যায়সংগত কথা বলতে কাউকে পরোয়া করেননি। এমনকি সেসময় কয়েক সপ্তাহ আগে দেয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের একটি বক্রোক্তিরও জবাব দেন খোদ সেদেশে বসেই।
ড. কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘Bangladesh is an international basket case।’ ওই সফরে ওয়াশিংটনে বসেই কিসিঞ্জারের বাজে বক্তব্যের জবাব দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘কেউ কেউ বাংলাদেশকে ‘international basket case’ বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ basket case নয়। দুশ বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পদ লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, মাঞ্চেস্টার, করাচী, ইসলামাবাদের। ... আজো আমাদের অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।”
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। সেই ভাষণ দেয়ার ৪৭তম বার্ষিকীতে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক।