বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইভ্যালিকাণ্ড: গুরু পাপে লঘু দণ্ড যেন না হয়

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:৩৪

ই-ভ্যালিকাণ্ডে রাসেল দম্পতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর গ্রাহকদের মূল ভাবনা তারা টাকা ফেরত পাবেন তো? যদি টাকা ফেরত না পান তবে সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক, আর প্রতারক ব্যবসায়ীরা ভাববে, গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিলেও চলে। হয়তো ক’দিন জেলের ভাত খেতে হবে। ক’দিন জেল খেটেও যদি শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়, মন্দ কী?

দেশে ই-কমার্সের বিকাশ হয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার তরুণের। ধীরে ধীরে এটি প্রসারিতও হচ্ছে। রাজধানীর পাশাপাশি মফস্বলেও এখন পৌঁছে গেছে অনলাইন সেবা ও ব্যবসা। কিন্তু কিছু ‘ফটকা’ ব্যবসায়ী এখানে ঢুকে পড়ায় পুরো ই-কমার্সই আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

ই-কমার্স শুধু একটি বাণিজ্য নয়, সেবাও। ডিজিটাল মাধ্যমে বেচাকেনা হয় মাত্র। পয়সা ও সময় খরচ করে বাজারে গিয়ে মুদি দোকানে দামাদামি না করে ওয়েবসাইট থেকে পণ্যের অর্ডার করেন ক্রেতারা। অর্ডারমতো বাড়িতে পৌঁছে যায় পণ্য। শুধু দেশের নয়, দেশের বাইরে থেকেও অনলাইনে পণ্য কিনতে পারি আমরা।

করোনাকালে গত প্রায় ১৮ মাসে ই-কমার্সের পরিধি আরও বেড়েছে। কোভিডকালে অনলাইন গ্রোসারির প্রসার হয়েছে। এসময়ে চালডালের মতো অনলাইন গ্রোসারির মাধ্যমে নিত্যপণ্য কেনা বেড়েছে বহুগুণ।

এ রকম একটি স্থিতিশীল, আস্থাশীল ও প্রসারমাণ বাজারে ঢুকে পড়েছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো কিছু ‘ফটকা’ ব্যবসায়ী। ক্রেতাদের লোভে ফেলে অস্বাভাবিক ডিসকাউন্টে পণ্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এরা। কিছু পণ্য ক্রেতাদের কাছে ডেলিভারি দিয়ে তারা বাজারে একটি পজিটিভ ইম্প্রেশন সৃষ্টি করতে চেয়েছে, তা পেরেছেও বটে। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহকই মাসের পর মাস অপেক্ষায় থেকেও তার পণ্যটি পাননি। ফেরত পাননি টাকাও।

কিছু পণ্য ডেলিভারি দেয়াটা আসলে তাদের কৌশলী ফাঁদ ছিল মাত্র। কারণ কেউ পণ্য পেয়েছে শুনে আরও অনেকেই নতুন করে পণ্য অর্ডার করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ রকম অস্বাভাবিক মূ্ল্য ছাড়ে পণ্য বিক্রি সম্ভব না।

এভাবে ডিসকাউন্ট অফারের খপ্পরে পড়ে ক্রেতারা লাখ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করেছেন। শুধু তাই নয়, ইভ্যালি বলেছে, তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য দিতে না পারলে বাজারমূল্যের চেক ফেরত দেবে। ফলে অনেক ক্রেতাই পণ্য অথবা বাজারমূল্য-দুটোর জন্যই অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।

তার মানে ইভ্যালি এখানে শুধু পণ্যের ব্যবসাই করেনি, টাকাও তাদের একটি পণ্য। তারা টাকার বিনিময়ে টাকা বিক্রি করেছে। দেশের ইকমার্স নীতিমালা অনুযায়ী এ ব্যবসা করা যায় না। দেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই ইভ্যালি এ ব্যবসা করেছে।

ই-ক্যাব (ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এ নিয়ে চিঠি চালাচালি করলেও ইভ্যালির বিরুদ্ধে শেষমেশ কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ইভ্যালির মালিক দম্পতি গ্রেপ্তার হওয়ায় সবাই এখন এ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যমান নীতিমালা (ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮ ও ডিজিটাল কমার্স অপারেশন গাইডলাইন ২০২১) অনুযায়ীই তাদের বিরুদ্ধে আগেই ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু তা হয়নি। তখন ব্যবস্থা নিলে গ্রাহকদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা কোনো ডিজিটাল প্রতারকের পকেটে যেত না। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ আরও কয়েকটি ‘হায় হায় কোম্পানি’ দেশে সৃষ্টি হতো না। ইভ্যালিকাণ্ডে দেশের ইতিহাসে যোগ হলো আরেকটি বড় মানি স্কাম।

ইভ্যালিকাণ্ডে রাসেল দম্পতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর গ্রাহকদের মূল ভাবনা তারা টাকা ফেরত পাবেন তো? যদি টাকা ফেরত না পান তবে সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক, আর প্রতারক ব্যবসায়ীরা ভাববে, গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিলেও চলে। হয়তো ক’দিন জেলের ভাত খেতে হবে। ক’দিন জেল খেটেও যদি শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়, মন্দ কী?

কাজেই, এখন গ্রাহকরা যাতে টাকা ফেরত পান, সে দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কেউ প্রতারিত হয়ে টাকা খোয়ালে বিদ্যমান আইনেই এর প্রতিকার সম্ভব। কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ।

গ্রাহকরা ইভ্যালির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারেন। থানায় অথবা আদালতে গিয়ে গ্রাহক এ মামলা করতে পারেন। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অভিযোগ প্রমাণিত হলে গ্রাহক তার পাওনা ফিরে পেতে পারেন। অভিযুক্ত রাসেল দম্পতির সম্পদ থেকেও আদালত গ্রাহকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার আদেশ দিতে পারেন। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে অভিযুক্তের বা দণ্ডিতের সম্পদ নিজের হেফাজতে নিতে পারে বা বাজেয়াপ্ত করতে পারে।

এছাড়া গ্রাহক চাইলে দেওয়ানি মোকদ্দমাও করতে পারেন। টাকা আদায়ে এটিই (মানি মোকদ্দমা) সবচেয়ে প্রচলিত পন্থা। এটিও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া সন্দেহ নেই। বাদী মামলা করলে বিবাদীপক্ষ সব সময় চেষ্টা করেন মামলাকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখতে। আর ক্ষুদ্র গ্রাহক সাধারণ দীর্ঘ মেয়াদে এ মামলা চালানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, হতাশ হয়ে যান।

এছাড়া কোনো কারণে চেক ডিজঅনার হলে চেক প্রদানকারীর বিরুদ্ধে হস্তারযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ (Negotiable Instrument Act)-এর অধীনেও মামলা করা যেতে পারে। ইভ্যালি যদি কোনো চেক দিয়ে থাকে ও তা ডিজঅনার হয় তবে ইভ্যালির বিরুদ্ধে এ মামলা করা যেতে পারে।

অতীতে আমরা দেখেছি যুবক, ইউনিপেটুইউ এবং ডেসটিনির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। গ্রাহকের কাছ থেকে এরা প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইভ্যালি ও ইউনিপেটুইউ-এর ব্যবসার ধরন প্রায় একই। ইভ্যালি ৪৫ দিনে ডিসকাউন্টেড মূল্যে পণ্য অথবা ব্যর্থতায় আনডিসকাউন্টেড বাজার মূল্য (টাকা) গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ফলে গ্রাহকরা অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্য কিনতে অথবা কম টাকা খাটিয়ে অল্প সময়েই অধিক মুনাফা লাভের আশায় ইভ্যালির ফাঁদে পা দিয়েছে। আর ইউনিপেটুইউ ১০ মাসে বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা গ্রাহককে ফেরত দেয়ার ফাঁদ পেতেছিল। অভিন্ন ফাঁদ। শুধু শিকারি আলাদা। আর ঘুঘু সেই পুরোনো গ্রাহক।

সে সময় ইউনিপেটুইউ’র চেয়ারম্যানসহ প্রতিষ্ঠানটির কজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় ইউনিপেটুইউর চেয়ারম্যানসহ ছয় কর্মকর্তার ১২ বছর করে কারাদণ্ড হয়। একইসঙ্গে জরিমানা করা হয় ২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।

ইভ্যালির বিরুদ্ধেও একই মামলা হতে পারে। কিন্তু ইউনিপেটুইউসহ অন্যান্য প্রতারক কোম্পানি ১৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেও এত কম টাকা জরিমানা দিলে অপরাধের তুলনায় শাস্তি হয় নগণ্য। গ্রাহকরাও টাকা ফেরত না পেয়ে হন ক্ষতিগ্রস্ত। তাই ফৌজদারি মামলার শাস্তি যেমন হতেই হবে, তেমনি নিশ্চিত করতে হবে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের বিষয়টিও।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইভ্যালির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪০৬, ৪২০ ও ৫০৬ ধারায়। ৪০৬ ধারার মামলাটি হলো অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের। এর শাস্তি বড় জোর তিন বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ড। আর ৪২০ ধারার শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা। ৪০৬ ধারার চেয়ে ৪২০ ধারায় শাস্তি বেশি ও অপরাধী একই সঙ্গে উভয়দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারে।

আর ৫০৬ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ৫০৬ ধারার অপরাধ হচ্ছে অপরাধমূলক ভিতি প্রদর্শন। ইভ্যালিকাণ্ডে অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন প্রমাণ করা সহজ কিছু নয়, আর এটি কীভাবে প্রাসঙ্গিক তাও বোধগম্য নয়।

আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। রাসেল দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা চলমান। মামলার পরিণতি কী তা গ্রাহকরা জানেন না। গ্রাহকরা শুধু জানেন তারা টাকা দিয়েছেন, আর ইভ্যালি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ইভ্যালির সব অ্যাকাউন্ট জব্দ করা প্রয়োজন।

গ্রাহকদের সঙ্গে ইভ্যালির সব লেনদেনের খতিয়ান বের করা কঠিন কিছু নয়। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই যথষ্ট। গ্রাহকরা প্রমাণ দিয়ে টাকা ফেরত নেবে। ইভ্যালির জন্য এখন একজন প্রশাসকও (রিসিভার) নিয়োগ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ইভ্যালির সব সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষেই ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেয়া যেতে পারে।

এছাড়া দেশে ভোক্তাস্বার্থ আইন আছে। ইভ্যালি মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। পণ্যের কথা বলে পণ্যও দেয়নি, টাকাও ফেরত দেয়নি। তাই এ আইনেও ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। কিন্তু এখানেও ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’।

এক বা দুই বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা- অতঃপর খালাস। কিন্তু তাতে এত বড় অর্থ কেলেঙ্কারির শাস্তি হয় না। বিদ্যমান আইনানুযায়ী শাস্তি যা হওয়ার হোক, হোক জরিমানাও। কিন্তু আম গ্রাহকদের চাওয়া একটাই-ক্যাশব্যাক, যে অফার ইভ্যালিই দিয়েছিল। ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে ই-কমার্স সেক্টরে। ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেয়ার মাধ্যমেই শুরু হোক এ কাজ।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর