বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঈশ্বরদীর ট্রেন হামলা: শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার রায় কার্যকর হোক

  • দুলাল আচার্য   
  • ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:৪২

আজ ২৩ সেপ্টেম্বর। ২৭ বছর আগে ১৯৯৪ সালের এদিনে পাবনার ঈশ্বরদীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের কামরায় অতর্কিত হামলা করে ক্ষমতাসীন সরকারে মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীরা। সেদিন তিনি সাংগঠনিক সফরে খুলনা থেকে রাজশাহীতে ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে তার নির্ধারিত পথসভা ছিল। তাকে বহনকারী ট্রেনটি পাকশী স্টেশনে পৌঁছার পর পরই ট্রেনে ব্যাপক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালানো হয়।

সাহস তাকে পরাভূত হওয়ার সব শক্তিমত্তাকে পর্যুদস্ত করে দেয়। সাহসের বরাভয় কাঁধে তিনি এগিয়ে চলছেন। কোনো বাধা-বিপত্তি তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না, পারেনিও। আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা, দক্ষতা, যোগ্যতা তাকে ধরে রাখে বাংলার অন্তরের গভীর অন্তরে, মানুষের জেগে ওঠার, বেড়ে ওঠার অনন্তর আবেগে। আলোকের ঝরনাধারায় দেশ ও দেশবাসীকে রাঙিয়ে দিতে কুণ্ঠাহীন তিনি। তেজস্বী মনোভাব তাকে দমিয়ে রাখার ক্ষেত্রকে করে সংকুচিত। সবুজ-শ্যামলে মোড়া বাংলাদেশকে পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় উন্নীত করতে নিরন্তর নিবেদিত তিনি।

একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখনও ওঁত পেতে আছে প্রতিশোধে। পঁচাত্তরের ঘাতক বাহিনী, যারা হত্যা করেছে পিতা-মাতা-ভাইসহ স্বজনদের, তারা চায় তার বিনাশ। তাকে নির্জন করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পাকিস্তানি ধারায় ফিরে যেতে চায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দেশটাকে তারা পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন স্বাধীনতার স্বপ্নবাহী পথে। সেই পথ মসৃণ নয়। অনেক চড়াই-উতরাই। সেসব পথ মাড়িয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন। তিনি শেখ হাসিনা।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা সম্পূর্ণ হয়নি, সেটাই বার বার করার চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীচক্র। সেই ’৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই ঘাতকের নিশানায় বঙ্গবন্ধুকন্যা। নানা সময়ে নানাস্থানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কখনও সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কখনও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অনুসারী, কখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীর ইন্ধন ও সহযোগিতায়। আর প্রতিটি ঘটনার পর রাজনৈতিক যোগসূত্র মিলে যায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি দলগুলোর কার্যক্রমের সঙ্গে।

কোনো কোনো হত্যাচেষ্টায় আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’ এই আদর্শে ঘাতকদের পক্ষ নিয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ২১ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড-বোমা ও গুলির হামলা হয়েছে। প্রতিটি হামলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই ছিলেন হত্যাকারীদের মূল টার্গেট। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বার বার বুলেট-বোমা তাড়া করে বেড়ায় তাকে? কেন বার বার হত্যাকারীদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা?

আজ ২৩ সেপ্টেম্বর। ২৭ বছর আগে ১৯৯৪ সালের এদিনে পাবনার ঈশ্বরদীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের কামরায় অতর্কিত হামলা করে ক্ষমতাসীন সরকারে মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীরা।

সেদিন তিনি সাংগঠনিক সফরে খুলনা থেকে রাজশাহীতে ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পথে ঈশ্বরদী স্টেশনে তার নির্ধারিত পথসভা ছিল। তাকে বহনকারী ট্রেনটি পাকশী স্টেশনে পৌঁছার পর পরই ট্রেনে ব্যাপক গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালানো হয়। ট্রেনটি ঈশ্বরদী পৌঁছানোর পরও একইভাবে বোমা ও গুলিবর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ঈশ্বরদী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

মামলাটি চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে শেষ করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হলেও আদালত তা গ্রহণ না করে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল ৫২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। পরে মামলায় ধারাবাহিকভাবে ৩৮ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। দেশের বাইরেও তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে। এসব হামলায় ৬৬ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হন। আহত কয়েক হাজার। চিরতরে পঙ্গু ও শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো এখনও বিচার পায়নি।

উল্লেখ করার মতো, এরশাদ আমলে দুবার, ১৯৯১ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে চারবার, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারবার, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার আমলে চারবার (২১ আগস্টসহ), সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একবার ও আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে চারবার হত্যাচেষ্টার প্রকাশ্য ঘটনাগুলো উল্লেখ করার মতো। শুধু ঢাকাতেই শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয় সাতবার। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলেও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে কয়েকটির। ২৩ সেপ্টেম্বরের হামলা এর একটি।

বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পাশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ১০ জন মারা যান নেত্রীকে ‘মানববর্ম’ তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে। এ ঘটনায় ৫ পুলিশের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয়ের সামনে তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তখন মারা যান যুবলীগকর্মী নূর হোসেন। ’৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা করে ফ্রিডম পার্টি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে।

১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে ফ্রিডম পার্টির কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে একটি সন্ত্রাসী দল। এই মামলার রায় হয়েছে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচন চলাকালে রাজধানীর গ্রিন রোডে গাড়ি থেকে নামতে ২০/২৫ জন সন্ত্রাসী গুলি ও বোমা হামলা চালায়। এরা সবাই বিএনপির কর্মী। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির রাসেল স্কোয়ারে জনসভায় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৪ মার্চ টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমার আখেরি মোনাজাত থেকে ফেরার পথে রবীন্দ্র সরণির মোড়ে সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনার গাড়িতে হামলা চালায়।

১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বক্তৃতা দেয়ার সময় মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে একদল সন্ত্রাসী। ১৯৯৯ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের গেটে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে বোমা ফাটায় সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় ৬ জন গ্রেপ্তার হয়।

একই সালের ১১ জুলাই ভুয়া ই-মেইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পুত্র-কন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি কলেজের পাশ থেকে ৭৬ কেজি এবং ২৩ জুলাই হেলিপ্যাডের কাছে ৪০ কেজির দুটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করেন সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে এক জনসভায় বক্তব্য রাখার কথা ছিল।

২০০১ সালের ৩০ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ঘাতকচক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ। ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সিলেটে নির্বাচনি জনসভায় শেখ হাসিনাকে হুজিবি বোমা পেতে হত্যার পরিকল্পনা করে। সভাস্থলের ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে জঙ্গিদের দুজন নিহত হলে চক্রান্ত ভেস্তে যায়।

২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা হয়। ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গেলে তার গাড়িবহরের ওপর গুলি ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দলের মিছিল-পূর্ব সমাবেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।

শেখ হাসিনা সেদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী। রক্তাক্ত ২১ আগস্টের এমন লোমহর্ষক ঘটনার উদ্দেশ্য আজ আর কারো অজানা নয়। আহতদের অনেককেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। অনেকেই ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। আলোচিত এ মামলাটির বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র হামলা করে হুজি, জেএমবি, জামায়াত ও বিএনপি মিলে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে।

জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে তাকে স্লো-পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন। এছাড়াও বেশ কয়েকটি ষড়যন্ত্র হয়েছে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টায়, কিন্তু ঘাতকরা সফল হয়নি।

ফিরে দেখা ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪

হামলার পরদিন (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪, শনিবার) বিভিন্ন পত্রিকায় এ ঘটনা নিয়ে নানা শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাতীয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়- “গতকাল শুক্রবার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালানো হয়েছে। ট্রেনযোগে গণসংযোগ কর্মসূচি পালনের একপর্যায়ে খুলনা থেকে ঈশ্বরদী পৌঁছালে এ ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে ঈশ্বরদী স্টেশনে ট্রেনটি প্রবেশের সময় কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয় একটি বগিকে লক্ষ্য করে। ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে কড়া পুলিশবেষ্টনীর মধ্যে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষের উদ্দেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতাকালে বোমা বিস্ফোরিত হয়। গতকাল শেখ হাসিনা সকাল ৯টা ১০ মিনিটে খুলনা থেকে রওয়ানা হন। ১১টি স্টেশনে সমাবেশ-জনসভায় বক্তৃতা শেষে ঈশ্বরদী এসে পৌঁছালে তিনি হামলার শিকার হন। ঈশ্বরদী স্টেশনে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিবেদক। তারা জানায়, সরকারি দলের সমর্থিত মস্তান বাহিনী এ হামলা চালিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে বিএনপি সমর্থকরা ঈশ্বরদী স্টেশনে আওয়ামী লীগকে সমাবেশ করতে বাধা দেয়। দিনব্যাপী ব্যাপক বোমা হামলায় ভীত ঈশ্বরদী স্টেশনের লোকজন অভিযোগ করে, পৌর চেয়ারম্যানের সমর্থনপুষ্ট মাস্তানরা এ হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে। বোমা হামলা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ঈশ্বরদীতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।’

স্টেশনে উপস্থিত আওয়ামী লীগকর্মীদের অভিযোগের তির একজন প্রতিমন্ত্রীর দিকে। তার নির্দেশে এ হামলা চালানো হয়েছে। সন্ধ্যায় রেলস্টেশনে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন ছিল। সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের মঞ্চও পুড়িয়ে দিয়েছে। ৬টা ৪৫ মিনিটে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষে ট্রেনটি ঈশ্বরদী স্টেশন ছাড়লে ট্রেনটি লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছাড়া হয়। শেখ হাসিনার নির্ধারিত সভাকে কেন্দ্র করে শহরে এবং সভামঞ্চের কাছাকাছি ব্যাপক বোমা হামলা ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। জনসভায় গোলযোগের সময় মাথায় বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হন যুবলীগকর্মী স্বপন।’

উল্লেখ্য, ২১ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদীতে বিএনপি ও ছাত্রদলের এক বিক্ষোভ মিছিল ঈশ্বরদী শহর প্রদক্ষিণ করে আওয়ামী লীগের সভামঞ্চের কাছে দুপুর ১২টার দিকে উপস্থিত হয় এবং মঞ্চ ভাঙচুর করে। মঞ্চ নির্মাণে যুক্ত কর্মীদের ওপর হামলা করা হয়। এ সময় ১৫ জন আহত হয়। মঞ্চের কাছে বিক্ষোভকারীদের বোমাবাজির কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুর রহমান শরীফের বাসভবনে সমবেত হন। এ সময় গোটা শহরে বোমাবাজি চলতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাজারখানেক কর্মী মিছিল করে ঈশ্বরদী থানা অতিক্রম করার সময় তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় পুলিশ এক রাউন্ড গুলি, এক রাউন্ড রাবার বুলেট এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। আওয়ামী লীগের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে নেতৃবৃন্দ পুলিশের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে মঞ্চের কাছাকাছি উপস্থিত হন।”

ঘটনায় সরকারের প্রেসনোট

১৯৯৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সরকারের দায়সারা একটি প্রেসনোট ছাপা হয়। এতে শেখ হাসিনার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, গতকাল বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বহনকারী ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেছেন, তার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সরকার জানাতে চায় যে, প্রাথমিক রিপোর্টে বিরোধীদলীয় নেত্রীর এ অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী স্টেশনে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে পরস্পরবিরোধী কতিপয় রাজনৈতিক দলের উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকরা উল্লিখিত স্টেশন দুটির আশপাশে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ায় লিপ্ত হয় এবং পটকা বিস্ফোরণ ঘটায়।

শুধু সরকারি প্রেসনোটই নয়, সেসময় ওই অঞ্চলের বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপর ঈশ্বরদী ও নাটোরে গুলিবর্ষণের কথিত অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য, বানোয়াট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন- ‘জাতীয় রাজনীতিতে চমক সৃষ্টির বা অতীত ঐতিহ্য আওয়ামী লীগের রয়েছে সাংবাদিক সন্মেলনের বক্তব্যে সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।’ তার এই ভাষ্য প্রেসনোটের ভাষাকে হার মানায়। সেই মন্ত্রী আজ প্রয়াত। কিন্তু তাকে ওই হত্যাচেষ্টার অন্যতম ‘ভিলেন’ হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত করেছে।

আশার কথা, ২০২১ সালের ৩ জুলাই এই হামলার মামলার রায়ে নয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। একই মামলায় ২৫ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১৩ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। আলোচিত এ মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নয়জন আসামির প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ২৫ জনের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুবছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। আর ১৩ জনের প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। হত্যাচেষ্টার বেশকয়েকটি মামলায় অপরাধীদের সাজা দিয়েছে আদালত। কিছু মামলার রায় কার্যকর নিয়ে রয়েছে এখনও আইনি প্রক্রিয়া চলমান। ২৩ সেপ্টেম্বরের মামলায় আসামিদের সাজা কার্যকর করা সময়ের দাবি।

বাঙালির আশার বাতিঘর শেখ হাসিনা। তিনি তার জীবনকে বাংলার মেহনতি দুঃখী মানষের কল্যাণে উৎসর্গ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব মানবতার দিকে দুর্বার গতিতে। গণমানুষের কল্যাণই তার রাজনীতির মূল দর্শন। ১৯৭৫ সালের শুরুতেই প্রশ্ন ছিল কেন শেখ হাসিনা টার্গেট।

১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ১৯৮১ সালের শুরুতে দলের দায়িত্ব নিয়ে দলকে তিনি শুধু চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ই আনেননি; বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে যেমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি এখন তিনি। বাঙালির জাতীয় বোধ জাগ্রত রাখার কারিগর শেখ হাসিনা। যার হাতে বাঙালি রাষ্ট্র ও বাঙালির সংস্কৃতি নিরাপদ। জঙ্গিবাদকে নির্মূল ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আর এ কারণেই তার নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে ঘাতকচক্র।

আদর্শিক বিরোধের কারণে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নির্মূল করার এমন পাশবিক ঘটনা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। শেখ হাসিনা বার বার বুলেট ও গ্রেনেডের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা এক বহ্নিশিখা। তিনি মানবতার জননী। বিশ্বের এক রোল মডেল। তাকে হত্যার জন্য কম প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। এখনও তৎপর ঘাতককুল। কিন্তু জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত তিনি অপ্রতিরোধ্য অদম্য বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন। কোনো ভয় তাকে কাবু করতে পারে না। জাতিকে তিনি অভয়মাঝে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্রমান্বয়ে। জয় হোক অভয়ের।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর