বিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ভাগ ভাগ করে ক্লাসে যোগ দিয়েছে। করোনাকালের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলতে শুরু করেছে, এমন বিশ্বাস ক্রমে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হয়ত খুলে যাবে।
রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হবে, এমন কথা বলছে কেউ কেউ। করোনার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তেমন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি। গত মার্চে ধর্মীয় চরমপন্থি কয়েকটি দল মাঠে নেমেছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব ভণ্ডুল করার জন্য। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে ইস্যু করেছিল।
বলেছিল- বিজেপির এই নেতা গুজরাটে মুসলিম হত্যার জন্য দায়ী। তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না। এর কিছুদিন আগে এই মহলটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি মুসলিমবিদ্বেষী, এ বক্তব্যের পেছনে সত্যতা থাকতেই পারে। কিন্তু তার বাংলাদেশ সফর ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সর্বশক্তি দিয়ে। তারা এক কোটি নাগরিককে আশ্রয় দেয়। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি জান্তা যাতে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দিতে না পারে সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের সর্বত্র প্রচার চালান।
সে সময় জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দল ছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পক্ষে। তারা আলবদর, রাজাকার বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যায় অংশ নেয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটা তারা চায়নি। কিন্তু তারা সফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারা বলছিল বাংলাদেশ টিকবে না। পাকিস্তানের কিছু লোক মনে করত- অচিরেই বাংলাদেশের নেতারা তাদের হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইবে, বলবে- ভুল হয়েছে হুজুর। আবার আমাদের পাকিস্তানে নিয়ে নেন। সেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে! অর্থনীতি ও সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে।
পাকিস্তানের সহযোগীরা এসব কেমন করে সহ্য করবে? কিন্তু সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করা এখন আর সম্ভব না। তাই একটু ঘুরিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছিল- নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না। এ জন্য তারা হরতাল ডেকেছিল। কটি জেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তারা। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা। তবে তারা ব্যর্থ হয়। জনগণ তাদের বক্তব্য গ্রহণ করেনি। করোনাকালে এসব শক্তি মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। অর্থনীতির চাকা সচল হোক, এটা চায়নি। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে বলেছে। এর কারণ শিক্ষার ঘাটতি পূরণ নয়। তারা মতলব গোপন করেনি। বলেছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়, সরকারবিরোধী তৎপরতা জোরদার করা যায়। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। ছাত্রছাত্রীরা পড়তে চায়।
সব বাধা জয় করতে চায়। একটি ছবিতে দেখেছি বন্যাকবলিত এলাকায় একটি শিশু কলাগাছের ভেলা চালাচ্ছে বাঁশের লগি দিয়ে, ভেলায় বসা চারটি শিশু। পাঁচজনের মুখেই মাস্ক। করোনাকালের বাস্তবতা। স্কুল ইউনিফর্ম পরেছে সবাই। লগি হাতে ছেলেটির কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। ভেলায় বসা চারজনই ছাত্রী, বই হাতে। করোনার প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর স্কুল খুলেছে, সেখানেই চলেছে তারা প্রকৃতির প্রচণ্ড বাধা উপেক্ষা করে। এ ছবিটি ফেসবুকে ঘুরছে, হয়ত কোনো পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে।
আরেকটি ছবি দেখেছি ফেসবুকে- যেখানে কলা গাছের ভেলা নয়, কাঠের নৌকায় চলেছে কয়েকজন। মাঝি ও যাত্রী সবাই মেয়ে- একজন লগি হাতে, অন্যরা বসা। চলেছে স্কুলে- তাদের মুখাবয়বে দৃঢ় সংকল্প- কোনো বাধা মানব না।
২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার একটি সংবাদপত্রে- দুই কিশোরী স্কুলের অবসরের সময় ছুটে গেছে পাশেই তাদের বাড়িতে- একজনের মা রোদে ধান শোকাচ্ছে। দুই ছাত্রী স্কুল থেকে ছুটে এসে তাকে ২০-২৫ মিনিট সাহায্য করে ফের ছুটল স্কুলে- অফ পিরিয়ড সময় যে শেষ!
আমার কেবলই মনে হয়েছে- বেগম রোকেয়া যদি এ দৃশ্য দেখতেন! তিনি নারী শিক্ষার প্রসার চেয়েছেন। জানতেন, এ পথ সহজ নয়। মেয়েরা বাধা পাবে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে। তার সময়টি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ। তারা নারী শিক্ষায় প্রকাশ্যে বাধা দিত না। কিন্তু নারী-পুরুষ, কেবল সীমিত সংখ্যক শিখবে- এটা চেয়েছে। এখন ধর্মের নামে নারীশিক্ষা বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চলছে। বেগম রোকেয়ার জন্য কাজ করা কি আরও কঠিন হতো?
কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে একটি ছবি ছিল লালমনিরহাট এলাকার। বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দের কাছেই ওই এলাকা। বন্যার পানিতে স্কুলে যাওয়ার পথের মাটির সড়কের একটি অংশ তলিয়ে গিয়েছিল। একদল ছাত্রী স্কুল ইউনিফর্ম পরা, সেই পানি ভেঙেই চলেছে ক্লাসে। হাতে বই তাদের। এরা কেউ বেগম রোকেয়াকে দেখেনি। কিন্তু তার আদর্শ অনুসরণ করছে। যে স্থানীয় সাংবাদিক ছবিটি পাঠিয়েছিলেন, তার ভাষ্য ছিল ভিন্ন- সড়কটি সময়মতো সংস্কার করা হয়নি বলে বন্যার সময় অশেষ কষ্ট করে ছাত্রীদের স্কুলে আসতে হয়। এ ভাষ্য সঠিক। কিন্তু আমি দেখেছি ছাত্রীদের চোখে-মুখে অদম্য মনোভাব- কেউ আমাদের রুখতে পারবে না। সুলতানার স্বপ্ন এরা বাস্তবে রূপ দেবেই।
মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন চেয়েছিলেন- প্রতিটি নারী যেন এগিয়ে যায়। কেবল পড়াশোনা নয়, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্র যেন তাদের দৃপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়। এমনকি তিনি দেশ প্রতিরক্ষার কাজেও নারীদের দেখতে চেয়েছেন সামনের সারিতে।
তার জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত- ১৮৮০ থেকে ১৯৩২, মাত্র ৫২ বছর। এ সময়ের বড় অংশ কেটে গেছে জীবন সংগ্রামে। কত বাধা মোকাবিলা করেছেন তিনি- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- বাধার প্রাচীর গড়ে তুলতে কতজনের উৎসাহের যেন শেষ নেই। কিন্তু তিনি থামতে জানতেন না। শত কাজের মধ্যেও লিখে গেছেন, সাহিত্যসাধনায় মগ্ন থেকেছেন। তার রচনা কেবল বাংলাভাষার পাঠকদের জন্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ।
বাংলাদেশে এখনও এমন শক্তি রয়েছে, যারা নারী শিক্ষা চায় না। কল-কারখানায়, কৃষিতে, গণমাধ্যমে, সরকারি অফিসে নারী কাজ করুক, নিজের অধিকার বুঝে নিক- সেটা চায় না। প্রকাশ্যেই হুমকি দেয়া হয়েছে- নারীকে থাকতে হবে ঘরে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসকরা যেমন বলছে- নারীর কাজ কেবল সন্তান উৎপাদন, তাকে প্রকাশ্যে আসা চলবে না।
এর প্রতিবাদ অবশ্য আফগানিস্তানেই আমরা দেখছি। আবার নারীকে ব্যবহার করেই নারী অধিকার খর্ব করার ঘটনা ঘটেছে আফগানিস্তানে। কয়েকদিন আগে ‘অবগুণ্ঠনবতী’ একদল নারীকে তালেবান শাসকরা রাজপথে নামিয়ে দিয়েছিল, যারা বলছে সোচ্চার কণ্ঠে- নারীদের আমরা রাজপথে দেখতে চাই না। তারা দাবি জানাতে পারবে না। তাদের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চলবে না। অফিসেও তারা যেতে পারবে না। তারা সাংবাদিকতা করতে পারবে না। টেলিভিশনে মুখ দেখাতে পারবে না। নারীকে ব্যবহার করে নারী স্বাধীনতা হরণের দাওয়াই! বাংলাদেশেও এমনটি ঘটতে দেখছি আমরা।
বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে ২০০৯ সালের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নারী শিক্ষার ওপর বাড়ি গুরুত্বারোপ করেছেন। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে (মাদ্রাসাসহ) প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের অর্ধেক ছাত্রী। তারা পরীক্ষায় ভালো করছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনেকেই কলেজে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখছে।
এটাও লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশে এখন শিল্প-কারখানায় যে শ্রমশক্তি, তার বেশিরভাগ নারী। তাদের কারণে রপ্তানি খাত সচল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তেজি। কৃষিতেও সফল। কে তাদের অগ্রযাত্রায় বাধার প্রাচীর তৈরি করে সফল হবে?
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে, এমন উদ্বেগজনক খবর দেখেছি। বাল্যবিবাহের ঘটনাও এসেছে সংবাদপত্রে। এ সব নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। কিন্তু রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যে উজ্জ্বল আলোকশিখা ধরে আছেন, তা পথ দেখাচ্ছে নারীর অগ্রযাত্রায়, কে তাদের রুখবে? সংবাদপত্রে ও সামাজিক গণমাধ্যমে যে সব ছবি ভাইরাল, আমাদের ভরসাস্থল তো আছেই!
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।