একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন তার। ব্যক্তিজীবনে আদিখ্যেতা কিংবা অহংবোধ তাকে স্পর্শ করেনি কখনও। সংগ্রামমুখী তার জীবনকর্ম। তার সাহস ও অনুপ্রেরণায় সর্বাগ্রে মায়ের অবদানকেই স্মরণ করেন। বোনের পাশে থেকে সেই মায়ের দেখানো পথেই এগিয়ে চলা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপনজন এবং পরামর্শকও বটে! কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকায়ও তাকে দেখা যায়।
আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রথম ডাকটি তিনিই দিয়েছিলেন। তিনি শেখ রেহানা। জাতির পিতার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। যিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
২০১০ সালে ‘বাবা’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে না পারার আক্ষেপ উদ্বেলিত হয় সেই কবিতায়। বাবার স্মৃতি তার কাছে এখনও অমলিন। স্নেহ-মায়া-মমতা-আন্তরিকতা-বন্ধুত্ব সবই পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। বাবা আর মায়ের অপরিসীম ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা জীবনে তাদের হারিয়ে অমানিশার অন্ধকারই দেখেছেন। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এখনও তিনি খুঁজে ফেরেন বাবা-মাকে। শোকের পাহাড় ভেঙে এগিয়ে যেতে যেতে ফিরেছেন সময়ের বাস্তবতায়। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির ধারায় নিজেকে রেখেছেন নানাভাবে সম্পৃক্ত।
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর, বঙ্গবন্ধুর সেই আদুরে কন্যা শেখ রেহানার জন্মদিন। ১৯৫৫ সালের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ তিনি ৬৬ বছরে পা রাখছেন।
তিনি আমাদের ‘ছোটআপা’। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনও সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি তিনি। নীরবে নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, সংগ্রাম করে যাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে। অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় রাজনীতিবিদদের। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে (সংস্কারের নামে) যে বিভক্তিকরণের অপচেষ্টা দেখা দিয়েছিল তা রুখতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন জেলে। সে সময়ে পর্দার অন্তরালে থেকে দলের ঐক্য বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা নিয়েছিলেন শেখ রেহানা। দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন সাহসী উচ্চারণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, শেখ রেহানা সেসময় দলকে যদি আগলে না রাখতেন তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস হয়তো অতীতের মতো অগণতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। সে সময় শেখ হাসিনার স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানির কার্লসরুইয়ে বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে থাকায় বেঁচে যান শেখ রেহানা। সেখান থেকে ভারতে চলে যান দুইবোন। পরে শেখ রেহানা পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান।
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৭৭ সালে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে শেখ রেহানা বিয়ে করেন ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিককে। বিয়ে হয় লন্ডনের কিলবার্নে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথি ও ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে। শফিক সিদ্দিক তখন বিলেতের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষারত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় থাকাকালে তিনি সেখানে এসেছিলেন।
শেখ রেহানাও বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহিদ হওয়ার পরে বড়বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মান থেকে দিল্লি চলে যান এবং সেখান থেকে পরে তাদের খোকা চাচার কাছে লন্ডনে চলে যান। এই প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে শেখ রেহানা বলেন-
“এমন পর্যায়ে যখন অনুভব করছিলাম আমার মাথার উপরে একটি ছায়া দরকার, ঠিক তখনই বিয়ের আলাপ আসে। শফিক সিদ্দিক তখন পড়াশোনার জন্য লন্ডনে। এ প্রস্তাব অবশ্য আব্বা বেঁচে থাকতেই নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। কিন্তু আব্বা বলেছেন, পড়ালেখা শেষ হোক এরপর দেখা যাবে। একই প্রস্তাব যখন আবার এলো তখন বোন শেখ হাসিনা তার মতামতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু নিজের মাথার উপরে একটি ছায়ার আশায় বিয়ের প্রস্তাবটিতে সম্মতি দেন তিনি।”
বিয়ের পরও দুঃখ-কষ্ট শেখ রেহানা ও তার পরিবারকে তাড়া করে ফিরেছে। এ সময় নতুন করে নানামুখী সংকট মোকাবিলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে তাকে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। এই প্রসঙ্গে শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণে বলেছেন-
“লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এর পর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে একজন শিপিং কর্পোরেশনের বড় অফিসার এ জেড আহমেদ আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন। আব্বার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুস ও মঈনুল ইসলাম সাহেবও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন মঈনুল ইসলাম সাহেব। ড. শহীদুল্লার নাতি মনসুরুল হক, তাকে আমরা হীরা মামা বলে ডাকি- তিনিও আমার জন্য অনেক করেছেন।”
বিয়ের পর পরই তিনি স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে, চাইলেও একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তখন তাদের ছিল না। সাদাসিধে ছোট একটি আড়ম্বরহীন ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন; বাস-টিউব, রেলেই চলাফেরা করতেন।
ড. শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে। তাদের বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি। ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত, গবেষণা সংস্থা সিআরআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের ট্রাস্টি। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক। মানবিক হৃদয়ের অধিকারী শেখ রেহানা। এই মানবিকতাই তাকে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করেছে।
এবার নিজের কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টানতে চাই। আমার কর্মজীবনেও তার এই মানবিকতার ছায়া আছে। সেই মানবিকতার অংশ আজ তুলে ধরছি। নতুন ব্যবস্থাপনায় ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর। শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত এই ম্যাগাজিনটিতে সহ-সম্পাদক হিসেবে আমার কাজ করার সুযোগ হয় শুরুর দিন থেকেই। যদিও রেহানা আপা অফিসে খুব একটা আসতেন না। তবে খোঁজ-খবর রাখতেন নিয়মিত।
তার হয়ে দায়িত্বপালন করতেন বেবী আপা (প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ)। সম্পাদক হিসেবে তার সঙ্গে আমাদের বেশ কয়েকবার সরাসরি দেখা ও কথা হয়েছে। লন্ডন থেকে ফোন করে বেবী আপাকে না পেলে আমাদের সঙ্গেও কথা বলতেন রেহানা আপা। সেই সূত্রে যতটুকু জানি এবং দেখেছি একজন মানবিক বড় বোনের ছায়া। কথার মাঝেই আমাদের আপন করে নিতেন। সেই সূত্রে আমরা সবাই তাকে ছোট আপা বলে সম্বোধন করতাম। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
২০১২ সালের কথা। আমি তখন জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সম্ভবত সেটা এপ্রিল মাস। একদিন বিকালে আমার মোবাইলে ফোন। বললেন, দুলাল বলছো? আমি বললাম, জি। কণ্ঠটি আমার কাছে পরিচিত মনে হলেও, তখন অনুমান করতে পারিনি। তিনি বললেন, আমি রেহানা আপা বলছি। বুঝলাম আমাদের ছোট আপা। বললেন, কাল ১২ দিকে গণভবনে এসো। তোমার জন্য পাস দেয়া থাকবে। গেইটে এসে বললেই হবে। আমি জি আপা বলার পর ফোনটি কেটে যায়।
পরদিন যথাসময়ে গণভবনে পৌঁছলাম এবং খুব অল্প সময়ে আনুষ্ঠানিকতা সেরে একটি রুমে বসলাম। কয়েক মিনিট পর আপা আসলেন। বললেন, কেমন আছ? তারপর নানা বিষয়ে কথা। আমার বাবা তখন খুব অসুস্থ তিনি সেটাও জানতে পারলেন। বললেন শাকিলকে (প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল) বলেছি তোমার কথা। জনকণ্ঠে কাজের পর তার সঙ্গে সিআরআইতে তাকে সহযোগিতা করবে। তোমার সমস্যা শাকিল দেখবে। আসার সময় আমার স্ত্রীর জন্য চারটি শাড়ি এবং একটি খাম দিয়ে বললেন, বাবার চিকিৎসা করাবে। আর শাকিলের সঙ্গে কালই দেখা কর। ভালো থেক। রেহানা আপার এই মানবিক সহযোগিতার জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। এখন প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ না হলেও আমাদের খোঁজ-খবর রেহানা আপা রাখেন।
মানুষের কল্যাণে বড়বোন শেখ হাসিনার পাশে সব সময়ই ভূমিকা রাখছেন শেখ রেহানা। এই বিষয়ে শেখ রেহানা নিজেই বলেছেন- “আমরা দুবোন একে অপরের পাশে আছি। দুজন দুজনকে সাহায্য করি। খুব ভালোবাসি।” বড়বোন শেখ হাসিনাও অকপটে বলে থাকেন- রেহানা ছাড়া তিনি পরিপূর্ণ নন। রেহানার মাঝে তিনি তার মায়ের ছায়া দেখতে পান। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ রেহানা।
শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে শেখ রেহানার ভূমিকাও সমার্থক। বরং আরও সুস্পষ্ট। বোন শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব নেতৃত্বের অংশীদার, তার পিছনে অন্যতম উৎসাহ শেখ রেহানার। শান্তির আলোকবর্তিকা হাতে আজ বিশ্বময় শেখ হাসিনার নাম-যশ। এই ক্ষেত্রেও শেখ রেহানার ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় মানুষের কল্যাণে তার দুকন্যার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক।
শেখ রেহানার জন্মদিন উপলক্ষে আজ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। আমরাও জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই। শুভ জন্মদিন ছোট আপা। দীর্ঘায়ু হোন।
লেখক: সাংবাদিক