হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার জন্মদিন আজ। তার জন্মদিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। সাধারণ্যে নেই কোনোরকম আয়োজনও। পারিবারিক পরিবেশে একান্ত আপনজনেরা কীভাবে তাকে পরিবারের গণ্ডিতে এই দিনে শুভকামনা জানান, তাও আমাদের অজানা। তবে পরিবারের বাইরে চেনাজানা ঘনিষ্ঠজনেরা যে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান, সেটা বুঝতে পারি। ১৩ সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের প্রিয় ‘ছোট আপা’র জন্মদিনে যে উচ্ছ্বসিত হন, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেন, সেটা আমাদের প্রায় সবারই জানা। এবারের জন্মদিনে তিনি অবশ্য দেশের বাইরে রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে যারা ভালোবাসেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে নিঃসন্দেহে এই দিনটি অনেক আনন্দের। কারণ বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় কন্যা শেখ রেহানা এমন একজন নারী, যিনি মানবিক গুণাবলিতে, অতি সাধারণ জীবন যাপনের আটপৌরে বাঙালিয়ানায় অনেকেরই মুগ্ধতা কেড়ে নেন। এই গুণাবলি তার প্রিয় বড় আপা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও দৃশ্যমান।
এত বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও শেখ রেহানা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে কখনও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা নেই। তাই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি। বরং নেপথ্যে থেকে প্রিয় বড় আপা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নীরবে-নিভৃতে ভূমিকা পালন করে চলেছেন তিনি।
১৯৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত দুজন দুজনের ছায়াসঙ্গীর মতোই সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়, শোকে-যন্ত্রণায় সমব্যথিনী হয়ে চরম দুঃসময় উজিয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তারা আজকের এই বাস্তবতায় এসেছেন এবং হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।
দুই বোনের এই মাধুর্যমণ্ডিত অন্তরঙ্গতা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। অবিস্মরণীয় এ কারণে যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর বিদেশে থাকার সুবাদে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পিতা-মাতা তিনভাইসহ নিকটাত্মীয়দের হারিয়ে অথই শোকের সাগরে ভেসেছেন তারা দুজনই। সেই চরম দুঃসময়ে জার্মানি থেকে ভারতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন আর শেখ রেহানা লন্ডনে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তাদের চরম দুঃখের সেই মর্মান্তিক ইতিহাস এবং যাপিত জীবন আজ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অনিবার্য অংশ।
বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার বিদুষী কন্যা এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্নেহের ছোটবোন হিসেবেও শেখ রেহানার জন্মদিনটি বিশেষ তাৎপর্যবহ। তাই এ দেশের গণমাধ্যমও এই দিনে শেখ রেহানাকে শুভেচ্ছা জানায় তার জন্মদিনের সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা বহমান তার শিরায়-শোণিতে। জাতির পিতা এবং বঙ্গমাতার জীবনাদর্শের ছায়াতেই বিকশিত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জীবন। সংগত কারণেই তাদের যাপিত জীবনের অনাড়ম্বরতা আর সহজ-সরল মানবিক গুণাবলি স্বাভাবিকভাবেই সচেতন মানুষকে মুগ্ধ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবলিক ফিগার বলে তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে দেশবাসীর যত জানা, অন্তরালে থাকা শেখ রেহানার জীবন ততটাই অজানা। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য থেকে এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে যতটুকু জানা যায়, তাতে শেখ রেহানা অসাধারণ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন এক আলোকিত নারী। তার নামে বরাদ্দ ধানমন্ডির বাড়িটিও জনহিতকর কাজে দান করেছেন তিনি।
শেখ রেহানার এই নিভৃতচারী অথচ প্রেরণাদায়ী ভূমিকার সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য বঙ্গমাতার চরিত্রের। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে তিনি সংসার যেমন সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুচারুভাবে পরিচালনা করেছেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কারাগারের দিনগুলোতে দলের নেতাকর্মী এবং সংশ্লিষ্টদের অনুপ্রাণিত করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধুকে গুরুত্বপূর্ণ সব পরামর্শ দিয়েছেন। চরম সংকটকালে সাহস জুগিয়েছেন। শেখ রেহানাও রাজনৈতিক মঞ্চের অন্তরালে থেকেই দলের সংকটকালে প্রিয় বড় বোন শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন এবং প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের শাসনভার তুলে নিলে বিপর্যয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তির প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আশির দশক থেকে আজ পর্যন্ত গত ৪০ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে, প্রতিটি নির্বাচনে বড়বোনের পাশে থেকে তাকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন।
বিশ্ব মানবতার কাছে বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচার চেয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে প্রথম আবেদনটি ১৯৭৯ সালের ১০ মে লন্ডনে বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে উপস্থাপন করেছিলেন শেখ রেহানা। সম্মেলনের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার পাঠানো বাণী পাঠ করেন শেখ রেহানা। এটাই ছিল কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে তার প্রথম বক্তব্য উপস্থাপন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই প্রথম ১৯৭৫ সালের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার বিচারের দাবি তুলে মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় সেদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি।
এর পরের বছর ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে অনুষ্ঠিত ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুসহ শহিদদের স্মরণে শোকসভার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সক্রিয় রাজনীতিতে অভিষেক হয়। ওইদিনই বঙ্গবন্ধুহত্যা তদন্তে আন্তর্জাতিক কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্যার টমাস উইলিয়াম এমপি, কিউসি। সর্ব-ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনে শেখ রেহানা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু থেকেছেন আড়ালেই। তিনি রাজনৈতিক মঞ্চের আড়ালে থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সরক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। মানতেই হবে মোহমুক্ত থাকার এ এক বিরল গুণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা দুজনেই মা হিসেবে অসামান্য সফল। তাদের স্বামী এবং সন্তানেরা উচ্চশিক্ষায় যেমন মেধায়, পাণ্ডিত্যে-প্রজ্ঞায়ও সবাই দেশ-বিদেশে স্বনামখ্যাত! পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ রেহানার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর শফিক আহমেদ সিদ্দিক দেশের গৌরবময় নাম। শেখ হাসিনার সুযোগ্য পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশকে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে নতুন পথ দেখিয়েছেন তার কোনো তুলনা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অনন্য কারিগর তিনি।
প্রধানমন্ত্রীকন্যা পুতুল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন-ব্যক্তিত্ব আজ। অন্যদিকে শেখ রেহানার পুত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই )এর প্রধান হিসেবে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি হিসেবে অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। ছোট কন্যা আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তীও গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস এডিটর হিসেবে লন্ডনভিত্তিক কন্ট্রোল রিস্ক-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।এমন সন্তানদের জননীই রত্নগর্ভা মা।
শেখ রেহানার জন্মদিনে এই কথাগুলো মনে এলো এ কারণে যে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিবারের খুব কম সন্তানই মানুষের মতো মানুষ হয়। অনেকের সন্তান কলেজের সীমানাও পার হতে পারে না। ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন তারা। তারা দলের জন্য যেমন পরিবারের জন্যও তেমনই কলঙ্ক বয়ে আনেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারে তার সন্তানরা যেমন কেউ উচ্চাভিলাষী কিংবা বখে যায়নি, তেমনই তার রক্তের ধারা যাদের শিরায় বহমান, তারাও কেউ নষ্ট হননি। বরং তারা প্রত্যেকেই দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। সাধারণ জীবন যাপন করেই তারা প্রত্যেকে অসাধারণ চিন্তা করেছেন, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ।
শ্রদ্ধেয়া শেখ রেহানা! প্রিয় ছোট আপা, আজ এই শুভ জন্মদিনে আপনাকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন। আপনার দীর্ঘায়ু হোক!
লেখক: কবি ও সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা), বিটিভি।