এখন মাসিক বাজারের তালিকায় চাল-ডালের সঙ্গে গ্যাসের সিলিন্ডারের নামটাও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। নাগরিক জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি গ্যাস। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নাগরিক জীবনের সঙ্গে জ্বালানির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- ভাত কাপড়ের সংগ্রাম বা কষ্টের কথা যত উচ্চারিত হয়, ভাত রান্না করার কথা ততটা আলোচিত হয় না। অথচ যত নগরায়ন বাড়ছে ততই জ্বালানি বা রান্নার উপায় কী হবে তা ভাবনা এবং দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গ্যাস সময়মতো পাবে কি না, সিলিন্ডারে সঠিক পরিমাণ গ্যাস আছে কি না এসব চিন্তার সঙ্গে প্রতিমাসে দাম বাড়বে কি না সেই দুশ্চিন্তাও এখন তাড়া করে ফিরছে গ্রাহকদেরকে।
বাজারে মোটা চাল ৫০ টাকা কেজি, ভোজ্য তেল ১৫৩ টাকা লিটার, চিনি ৮০ টাকা কেজি, ডাল ১০০ টাকা। মানুষ নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে ভিড় বাড়ছে এবং লাইন দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির ট্রাকের পিছনে। ট্রাকে সয়াবিন তেল ১০০ টাকা লিটার, চিনি ও ডাল ৫৫ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হয়। ঢাকায় ৮০টি ট্রাকের পণ্য দুই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু মানুষের লাইন শেষ হয় না। একটু সাশ্রয় পাবার জন্য মানুষ চেষ্টা করছে এখন সেপ্টেম্বর মাসে এলপিজির দাম সিলিন্ডার প্রতি ৪০ টাকা বাড়ানো হলো। প্রতিমাসে এলপিজি বা তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি চালু হয়েছে।
এলপিজির মূল উপাদান প্রপেন ৩৫% ও বিউটেন ৬৫%, এই দুই উপাদানের দাম প্রকাশ করে সৌদি আরামকো। একে সৌদি কন্টাক্ট প্রাইস বা সিপি বলা হয়। প্রতিমাসে মূল্য নির্ধারণের ফল হিসেবে সেপ্টেম্বর থেকে দাম বাড়ানো হলো তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। বাড়ানো কথাটা শুনতে ভালো লাগে না তাই এখন বলা হয় মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। ভোক্তাপর্যায়ে নতুন করে এলপিজির মূল্য সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এর ফলে বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পড়বে ভ্যাটসহ ১ হাজার ৩৩ টাকা। গত মাসে এর দাম ছিল ৯৯৩ টাকা।
অর্থাৎ প্রতি সিলিন্ডারে দাম বেশি দিতে হবে ৪০ টাকা। ১ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে। বেসরকারি খাতের গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির এলপিজির দাম পরিবর্তন করা হয়নি। কারণ, উৎপাদন পর্যায়ে ব্যয় পরিবর্তন হয়নি। সরকারি মালিকানা কোম্পানির সাড়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৫৯১ টাকা। গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির দামও বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে লিটারপ্রতি ৫০ টাকা ৫৬ পয়সা। গত মাসে এর দাম ছিল ৪৮ টাকা ৭১ পয়সা। গৃহস্থালি গ্যাসের ঘোষিত মূল্যের চাইতে বাস্তবে সারা দেশে গ্রাহকদেরকে দিতে হয় আরও বেশি।
দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের ১১ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বাসা-বাড়িতে। অপরদিকে বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশ বা ৬০ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহারকারী। সামান্য কিছু মানুষ বিদ্যুতের সাহায্য নেয়। এছাড়া বাকি প্রায় ৭৫ ভাগ জনগোষ্ঠী রান্নায় জ্বালানির জন্য বায়োমাসের ওপর নির্ভর করে থাকে। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রন্ধনকাজের পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও অটোমোবাইল খাতেও এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেশ ক্রমাগত বাড়ছে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোম্পানির ব্যবসা আর ব্যবহারকারীর বিড়ম্বনা ও ব্যয় বৃদ্ধি।
বাজার অর্থনীতিতে নাকি চাহিদা এবং জোগান দ্বারাই সব জিনিসের দাম নির্ধারিত হয়। তাহলে প্রথমেই দেখা যাক এ দেশে এলপি গ্যাসের বাজার তথা চাহিদা ও জোগান কেমন? ২০১৩ সালে দেশে এলপি গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল যেখানে মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০ সালে তা বেড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৩০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে বাজার বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
অর্থাৎ চাহিদা ক্রমবর্ধমান। ২০০৮ সালে এ দেশে গৃহস্থালি রন্ধনকাজে মাথাপিছু এলপি গ্যাসের ব্যবহার ছিল ০.৩ কেজি, কিন্তু ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫.৬৩ কেজিতে। যদিও গৃহস্থালি রন্ধনকাজে দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে তা সত্ত্বেও এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় এখনও যথেষ্ট কম। যেমন জাপানে মাথাপিছু এলপি গ্যাসের ব্যবহার ৫৮ কেজি, মালয়েশিয়ায় ২১, ভারতে ১৬, ভিয়েতনামে ১৩ কেজি।
চাহিদা এবং মুনাফা যেখানে, সেখানেই পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা ছুটবেন, বিনিয়োগ করবেন। জ্বালানির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বর্তমানে ২৯টি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুতকরণ, বিতরণ, সরবরাহের কাজে নিয়োজিত। এলপিজির ডিলার প্রায় ৩ হাজার, আমদানিকারী অপারেটর ২০টি এবং এলপিজি আমদানি টার্মিনাল রয়েছে ১৪টি। বাংলাদেশ মূলত কাতার, সংযুক্ত আরব-আমিরাত এবং সৌদি আরব থেকে এলপিজি আমদানি করে থাকে। এই এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে, তার মানদণ্ড বা মাপকাঠিইবা কী হবে তা নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি মূল্য নির্ধারণের একটি সুপারিশ আছে।
এই সুপারিশমালার ৮ (১০) ক্রমে দেখা যায়, মোট ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের ইমপোর্ট প্যারিটি প্রাইস, অভ্যন্তরীণ পরিবহন, ডিলারদের মার্জিন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যেমন মজুত, বিপণন ও বিতরণ, সংশ্লিষ্ট অবচয় যেমন মজুত, বিপণন ও বিতরণ, আয়কর ও অন্যান্য মজুত, বিপণন ও বিতরণ-সংশ্লিষ্ট কর অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করে মূল্যহার নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ভোক্তাদের স্বার্থে প্রয়োজন।
উন্নত অনেক দেশ যেমন জাপানে প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন লাইনের পাশাপাশি এলপিজি ব্যবহার করা হয়। ভারতে এলপিজি ব্যবহারকারী প্রতিটি পরিবার বছরে প্রথম ১২টি ১৪.২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার ভর্তুকিতে পেয়ে থাকে। কোনো পরিবার এর চেয়ে বেশি ব্যবহার করলে বাজারমূল্যে ব্যবহার করে থাকে। জাপানে এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শীত-গ্রীষ্মে সঞ্চালনের প্রেশার পরীক্ষা করে রিফিলিং বা প্রতিস্থাপন করে থাকে।
এলপিজি গ্রাহক প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকের মতোই মাসিক বিল পরিশোধ করেন। ভারতেও এলপি গ্যাস সরবরাহ এবং ব্যবহার বেশ সহজতর। সেখানে প্রথমত নিয়ম মেনে ব্যবহারকারীকে নিবন্ধন করতে হয়। গ্রাহক বিভিন্ন মাধ্যম যেমন- বিপণন এজেন্সি, অনলাইন অর্ডার, মোবাইল অ্যাপস, এসএমএস, আইভিআরএস বা ইন্টারঅ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে গ্যাস পেতে পারেন। বাংলাদেশেও জ্বালানি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সাধারণ গ্রাহকরা ক্ষতির সম্মুখীন না হন সে বিষয় দেখা প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে।
বাংলাদেশে ভোক্তার স্বার্থ দেখবে কে? একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, ছোট দেড় হাজার, তিন হাজার টনের জাহাজে না এনে বড় জাহাজে অর্থাৎ ১৫ হাজার টনের জাহাজে এলপিজি পরিবহন করলে পরিবহন খরচ টনপ্রতি ১১০ ডলার থেকে ৬৯ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় এলপিজির একটা বড় অংশ ব্যবহার করে সেনাবাহিনী, বাকিটা খোলা বাজারে বিক্রি হয়।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস, হাসপাতালের ক্যান্টিনে যদি এই এলপিজি সরবরাহ করা হয় তাহলে খাবারের খরচ কমানো সম্ভব। সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১২ কেজির সিলিন্ডারের সৌদি সিপি- ৬৭০ টাকা, জাহাজ ভাড়া- ৯৭ টাকা, রিভার ডিউজ- ৬ টাকা, বোতলজাতকরণ চার্জ- ১৪৩ টাকা, মূল্যসংযোজন কর- ৬৬ টাকা, ডিস্ট্রিবিউটর চার্জ- ২৪ টাকা, রিটেইলার চার্জ- ২৭ টাকা সব মিলে ১০৩৩ টাকা। এই হিসাব ঠিক আছে কি না তা দেখার দায়িত্ব কার? আগামী মাসে যে দাম আবার বাড়বে না সে নিশ্চয়তাইবা কে দেবে?
বাংলাদেশে গৃহস্থালি জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ আর না দেয়া এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় এলপিজি সরবরাহকারী কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেডকে ছোট করে রাখার (যারা মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহে সক্ষম) ফলে এলপি গ্যাসের বাজারে বেসরকারি কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে সাতটি কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা আলোচনা করে ঠিক করেন কত দামে বিক্রি করবেন।
শহরাঞ্চলের ভোক্তারা এখন ভীষণ অসহায়। এখন তো তাদের লাকড়ি ব্যবহার করার উপায় নেই ফলে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। এককেজি এলপিজি ব্যবহার করলে ১৮ কেজি কাঠ বেঁচে যায়। চুলার ধোঁয়ার কারণে বছরে ১৬ লাখ নারী শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকে বলে জানা যায়। ফলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষাতেও রান্নায় গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়াতে গিয়ে মূল্য বৃদ্ধির চাপে যেন জীবন দুর্বিষহ না হয় সেটা দেখতে হবে। একদিকে এলপিজির বাজারমূল্য অস্থিতিশীল, যা চলতি মাসে ৯৫০ তো অন্য মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা। আবার ১২ কেজির সিলিন্ডারে কখনও ১ মাসও যায় না।
সে ক্ষেত্রে এলপিজি ব্যবহারকারী মাসে গড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকার বেশি খরচ করে থাকে। শ্রমজীবীদের কথা নাইবা বলি, মাসে ৩০ হাজার টাকা উপার্জনকারীর যদি আয়ের ৫ থেকে ৬ শতাংশ জ্বালানির জন্য ব্যবহার করতে হয় তাহলে সংসার চালানো যে কত কঠিন তা তারা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সাধারণ আয়ের মানুষের জীবনে নতুন আঘাত হানছে। করোনায় কতভাবে মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়েছে তার সীমা নেই। তাদের আয় কমেছে কিন্তু খাদ্য-চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে। ফলে জীবনের চাহিদাগুলোকে প্রতিদিন ছোট করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ আয়ের মানুষ। তাদের জীবন যাপনের যন্ত্রণাকে আরও একটু বাড়িয়ে তুলবে জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধি।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।