বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিএনপি যে কারণে মেগা প্রকল্পের বিরোধিতা করে

  •    
  • ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৭:৪৯

বিরোধীরা যদি কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কারা কারা করেছে, সেসবের তথ্য উপাত্ত হাজির করে সমালোচনা করত তাহলে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বিরোধীদের যেকোনো ডাকে সাড়া দিতে পারত। কিন্তু জনগণ বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের নেতাদের মুখে কেবল ‘দুর্নীতি দুর্নীতি’ শব্দই শুনেছে কিন্তু তথ্য-উপাত্ত দেখেনি।

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে যে বিষয়টি আমি লক্ষ করেছি তা হচ্ছে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কাজের তথ্যনির্ভর সমালোচনার চাইতে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত প্রায় সব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার একটি অভ্যাস ভেতর থেকেই রপ্ত করে ফেলেছে। এর ফলে সমালোচনা ও বিরোধিতা যে দুটো ভিন্ন বিষয় সেটি যেন তাদের কাছে একাকার হয়ে গেছে। বিরোধী দলের সমালোচনার ক্ষেত্রে তথ্য ও যুক্তি জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরিতে সাহায্য করে।

অন্ধের মতো বিরোধিতা করার ফলে তেমন কিছু অর্জিত হয় না। আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বলে সবার কাছেই স্বীকৃত। কিন্তু দলের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনার চাইতে বিরোধিতার নজির যেভাবে দেখিয়ে যাচ্ছে তাতে জনমনে খুব বেশি প্রভাব পড়ে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে বেশ কিছু খাতে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু মেগাপ্রকল্প গ্রহণ শুরু করে।

অনেকের কাছেই এসব মেগাপ্রকল্পের অভিজ্ঞতা ছিল না। কেননা আগের কোনো সরকারই দেশ পরিচালনায় তেমন কোনো মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করেনি। সব কিছুই চলেছে ধীরগতিতে, অনেক ক্ষেত্রেই এডহক ভিত্তিতে। সেকারণে অনেক ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সরকারগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস দেখায়নি। তাছাড়া বেশিরভাগ সরকারই অতীতে বিদেশনির্ভর প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কোনো দেশ সেভাবে বাংলাদেশকে অর্থায়নও করেনি।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিশেষত বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ যেভাবে পিছিয়ে পড়ে, তাতে দেশের অর্থনীতিই শুধু থমকে দাঁড়ায়নি, জনজীবনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমাদের তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ৩,২০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট। অথচ আমাদের প্রয়োজন ছিল ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট।

শেখ হাসিনার সরকার দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে। তখন বিএনপিসহ অনেকেই দেশের বিদ্যুতের চাহিদার বিষয়টিকে গুরত্ব না দিয়ে এভাবে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়ায় কঠোরভাবে সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা দাবি করতে থাকেন যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে ঘুষ-দুর্নীতি করাই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য।

বিরোধীরা যদি কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কারা কারা করেছে, সেসবের তথ্য উপাত্ত হাজির করে সমালোচনা করত তাহলে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বিরোধীদের যেকোনো ডাকে সাড়া দিতে পারত। কিন্তু জনগণ বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের নেতাদের মুখে কেবল ‘দুর্নীতি দুর্নীতি’ শব্দই শুনেছে কিন্তু তথ্য-উপাত্ত দেখেনি।

মানুষের কাছে তখন বিদ্যুতের অপর নাম জীবন হয়ে উঠেছিল। সরকার সমালোচনার সব কিছু চোখ বুজে হজম করেছে। ছোট, মাঝারি ও বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে দ্রুত বিদ্যুতায়নে দেশকে এগিয়ে নিতে সরকার বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে চমক দেখাতে শুরু করে তা ছিল অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সরকার দেশের অর্থনীতি, নগরজীবন, গ্রামীণ জীবনসহ সবকিছুকে যে গতিময়তা দিতে সক্ষম হয়েছিল তার ফলে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত বেড়ে যায়, দেশে শিল্পায়ন, সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হওয়ার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকায় সত্যি বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে যা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাকে এখন ২০ হাজার মেগাওয়াটের উপরে নিয়ে এসেছে। অচিরেই তাতে আরও কয়েক হাজার মেগাওয়াট যুক্ত হতে যাচ্ছে।

বিএনপি শুধু বিদ্যুৎ নিয়েই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা সরকার যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেগুলোর প্রতিটিরই তীব্র বিরোধিতা করেছে, এখনও করছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপি শুধু সমালোচনাই করেনি, নানা ধরনের অপপ্রচারও ছড়িয়েছে। দেশ-বিদেশে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থ লোপাটের নানা কল্পকাহিনি প্রচারও করে বেড়িয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাংক তখনও অর্থই ছাড় দেয়নি। এর আগেই হাজার হাজার কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যগণ ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছেন বলে বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং জামায়াতসহ আরও কিছু দলের নেতাকর্মী গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে রাতদিন প্রচার চালায়। সাধারণ মানুষ তাতে বিভ্রান্তও হয়। বেশ কিছু গণমাধ্যম উদ্ভট তথ্য সরবরাহ করে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সংবাদ, প্রতিবেদন এবং নিবন্ধও ছেপেছিল। পদ্মা সেতুর প্রয়োজনীয়তা এদের কারো কাছেই অনুভূত হচ্ছিল না।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে তারা যেন ঘুমেও দুর্নীতির স্বপ্ন দেখছিলেন! অথচ আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রবণতা কোথায় কেমন আছে সেটি কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু অন্যকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেকে সাধু হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও এই সমাজে কম নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে তখন যারা সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছিলেন তারাই পরে দেখেছেন যে, বিশ্বব্যাংক কোনো টাকাই ছাড় দেয়নি।

বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘুঁটি চালতে গিয়ে অর্থায়ন বন্ধ করে পদ্মা সেতুর উদ্যোগ ভেস্তে দেয়ার ব্যবস্থা করে। তখন সমালোচকরা দেশব্যাপী দুর্নীতির জিগির তুলে ঢোল-কাঁসা, বাটি-হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে যেভাবে দেশ-বিদেশে চেঁচামেচি শুরু করেছিল তাতে মনে হয়েছিল তাদের যেন বিজয় হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেন তখন এদের কেউ কেউ দাবি করেছিলেন যে, ওই সেতু দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না, পারও হওয়া যাবে না! ওইসব সমালোচনা কোনো মানদণ্ডেই পড়ে না। কিন্তু শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মেগা প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। এই চ্যালেঞ্জ তিনি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছেন।

আগামী বছরই হয়তো পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল এবং সব ধরনের যানবাহন চলাচল করবে। এটি শুরু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতিবছরে ২ শতাংশ করে বাড়তে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। গোটা বিশ্বই এখন পদ্মা সেতুর নির্মাণ কর্মযজ্ঞের দৃশ্য দেখে অভিভূত। বাংলাদেশের মর্যাদা এখন এতোটাই উপরে যে পৃথিবীর অনেক দেশই শেখ হাসিনার দেশপ্রেম, নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস দেখে অভিভূত।

শেখ হাসিনার সরকার রূপপুর পারমাণবিক মেগা প্রকল্প যখন গ্রহণ করে তখন অনেকেই এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এখন সেই মেগা প্রকল্পও প্রায় বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কোনো দিনই ভাবতে পারেনি ঢাকা শহরে মেট্রোরেল দেখতে পাবে। এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কী তাও অনেকেরই জানা ছিল না । চট্টগ্রাম কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে ৩.৩২ কিমি টানেল তৈরির কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।

মাতারবাড়ি ডিপ সি পোর্ট নির্মাণের কাজও চলছে স্বাভাবিক গতিতে। এরই মধ্যে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ ১৭০০ ফিট মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, পর্যটন এবং রিফুয়েলিংয়ের যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটিও দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ ও উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর নির্মাণের কাজও ৭২ শতাংশ শেষ হয়েছে। মংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮টি উন্নয়ন প্রকল্পসহ ৫০টিরও অধিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর ফলে মংলা বন্দরের সঙ্গে দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চল এবং ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।

এই মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশ করোনার এমন বৈশ্বিক অতিমারির সংকটকালেও একের পর এক বাস্তবায়ন করে চলছে। বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পই সামনের বছরগুলোতে সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি, কারিগরি জ্ঞান, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওপরে উল্লিখিত যেসব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অবশ্যই বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এগুলো চলছে বলেই দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান যেমন হয়েছে, বিপুল সংখ্যক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক তৈরি হচ্ছে যারা নিকট ভবিষ্যতে নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবেন। দেশে মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এসব মেগা প্রকল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ থেকে ভবিষ্যতে অনেক বিশেষজ্ঞ অন্যান্য দেশে নানা মেগা প্রকল্পে কাজ করার জন্য যেতে পারবেন।

বাংলাদেশে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো ট্রেন ইত্যাদি মেগা প্রকল্প নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতায় নির্মাণ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া এখন আর কোনো স্বপ্নের বিষয় হবে না। বাস্তবে গ্রহণ করার উদ্যোগ নেয়া সহজ হবে। মেগা প্রকল্প দেখে বিএনপির নেতারা কেন এত সমালোচনামুখর হচ্ছেন তা আমরা বুঝতে পারছি না। তাদের এই মেগা প্রকল্পবিরোধী অবস্থান দেখে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা একসঙ্গে এতসব মেগা প্রকল্প শুধু গ্রহণই করেননি, বাস্তবায়নও করে চলেছেন। এটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সাফল্য যা দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। আগামী দিনের নেতৃত্বকে এমনই দৃঢ় সাহসী ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। বিএনপি কী তা ভেবে ভয় পাচ্ছে?

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর