বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জীবনকে ভালোবাসতে হবে

  • মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ   
  • ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৫:০৩

মানবিকতার বিকাশ ছাড়া আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়। আত্মহত্যাকে ‘না’ বলতে হবে। জীবনকে ভালোবাসতে হবে। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর বুকে আমাদের আগমন কেবল একবার। সেই এক জনমকে ব্যর্থতা দিয়ে নয়, সফলতা দিয়ে পূর্ণ করে তুলতে হবে। যতক্ষণ নিজের আত্মবিশ্বাস প্রখর আছে, ততক্ষণ তিনি দুর্বল নন। জীবনটাই যুদ্ধক্ষেত্র। হারলেন কি জিতলেন, তা মুখ্য নয়। যোদ্ধা হয়ে বেঁচে থাকাটাই সাফল্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকুল হয়ে বলেছিলেন, “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” অথচ সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় ওপারে চলে যেতে যান। যাকে আমরা বলি আত্মহত্যা বা আত্মহনন। স্বভাবতই মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রবণতাটাই বেশি৷ তবে তার মনে যখনই ‘নেই, হবে না’ এমন আক্ষেপগুলো ভেসে ওঠে তখনই বেছে নেয় এই নির্মম পথ। যা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য আমাদের সমাজে কখনই কাম্য নয়। কেননা এটি কখনই সমাধান হতে পারে না। এ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসে যে সফল হওয়া যায় তা উপলব্ধি করতে হবে। শুরু করতে হবে নতুন জীবন।

পত্রপত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে আর পাঁচটি সামাজিক সমস্যার মতো আত্মহত্যার খবরও। দীর্ঘদিনের ডিপ্রেশনকে বয়ে নিতে নিতে মানুষ ক্লান্ত হলেই এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় বলে বলেন বিশেষজ্ঞরা৷ অনেক কারণেই আত্মহত্যার এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তার মধ্যে প্রেমঘটিত ও পারিবারিক সমস্যাই নেপথ্যে কাজ করছে বেশি৷

বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কাজের মাঝে জাগাই আশা’ (ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন)।

মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারে। এর মধ্যে ডিপ্রেশন, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতর মানসিক রোগ। তাছাড়া মাদকাসক্তি, এনজাইটি, অপরাধ বোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, প্রেমকলহ, অভাব-অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, মা-বাবার ওপর অভিমান, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে থাকেন। আবার কারো ক্ষেত্রে কারণ থাকে অজানা। করোনাকালে হতাশা আর অভাব কেড়ে নিয়েছে অনেকের প্রাণ। পিছিয়ে নেই বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিংবা তরুণ প্রজন্মও। এ সময়টাতে না বুঝেই ভুল করে বসছে অনেকে।

গত ১৭ মাসে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই ৪০। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য হারে এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু দিন আগেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টার সংবাদ পাওয়া গেছে।সব কিছু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই একটা জায়গাতে এসেই আমরা হেরে যাই। আর তা হলো অভিমান, আবেগ ও জ্ঞান-বুদ্ধিহীন বিচারক্ষমতা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এর অর্থ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। এছাড়া আরও অনেক মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সারা বিশ্বে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে তার ৭৫ শতাংশ বা তিন-চতুর্থাংশই হয়ে থাকে নিম্ন বা মধ্য আয়ভুক্ত দেশগুলোতে। এই তালিকাতেই বাংলাদেশের স্থান দশ নম্বরে।

আত্মহত্যা কোনো সহজ কাজ নয়। সুস্থ মানুষের পক্ষে কখনও এই পথ বেছে নেয়া সম্ভব নয়। আত্মহত্যার প্রবণতা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। আর এ সমস্যা তৈরি হয় প্রচণ্ড ক্রোধ, আবেগ ও অপ্রাপ্তি থেকে। একজন মানুষ যখন মনে করে যে তিনি বেঁচে থাকার সমস্ত উপকরণ হারিয়ে ফেলেছেন এবং তার চলে যাওয়ায় পৃথিবীর কিছু যায় আসে না, তখনই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এটা তার অভিমান।

সেই অভিমান যে ভুলও হতে পারে, তা বিচার করার মতো মানসিক ক্ষমতা তার থাকে না। আবার অনেকেই জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, পারিবারিক সহায়তার অভাবে, একাই নিজের জীবনের সমাপ্তি টানতে এই পথ বেছে নেন। কেউ কেউ তার ভুল কোনো পদক্ষেপের মাশুল হিসেবে আত্মহত্যা করেন।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ১ হাজার মৃত্যুর মধ্যে ১৩ জনই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আবার প্রতি ১০০টি আত্মহত্যা ঘটানো মানুষের মধ্যে ৫৮ জনের বয়সই ৫০ বছরের নিচে। যাদের বিষণ্ণতা রোগ রয়েছে, অন্যদের চেয়ে তারা ২০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। যা বেড়েই চলেছে। বিষয়টি মোটেও ইতিবাচক নয়।

আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার যোগাযোগ, বিশেষ করে অবসাদ ও মদ্যপানের সংযোগ রয়েছে বলে এ তথ্য এখন প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখাচ্ছে বহু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে সংকটকালে এবং ব্যক্তিবিশেষে কোনো ধরনের কঠিন চাপ নিতে না পারলে।

তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের করোনাকালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে। এদিকে দেশে চলমান মহামারির মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন বলে তথ্য দিয়েছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

আত্মহত্যার প্ররোচনা থেকেও এর সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কীটনাশক পান করছেন আত্মহত্যাকারীরা। কীটনাশক পানে আত্মহনন ঘটছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর গ্রামীণ কৃষি এলাকায়। এ ছাড়া গলায় ফাঁস দেয়া ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার আত্মহননের একটি পদ্ধতি।

পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই আত্মহত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, আত্মহত্যা মহাপাপ! এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে ওটা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করব, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।” (সুরা নিসা ২৯-৩০)।

আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, একটি পরিবার ও আত্মহত্যাকারীর আপনজন বন্ধু-বান্ধবদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই আত্মহত্যার আগে নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে অন্যের কাছে কমবেশি তথ্য দেয়। সেসব তথ্যকে নজরে রেখে, পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব সবাই যদি সতর্ক থাকে এবং সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নেয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।

প্রয়োজনে ডাক্তার বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি, প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, একে অপরের প্রতি সদয় মনোভাব থাকতে হবে। সমস্যা হতেই পারে। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই জীবন। সেটাকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

মানুষের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্ররোচনা বন্ধ করাও জরুরি। ভাঙতে হবে মৌনতা। মানুষ যখন একেবারে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে তখনই মনে করে তার জীবন শেষ। তবে এখানেই হেরে গেলে চলবে না। জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। আত্মহত্যা মানেই জীবন শেষ, আর এই শেষ যে জীবনের যবনিকা নয়, সেটি সব ধর্মেই স্পষ্ট করে বলা আছে। আত্মহত্যার দাঁড়প্রান্ত থেকে ফিরে এসে জীবনে সফলতার সোপানে পৌঁছেছেন এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তাই মনে রাখতে হবে কোনো কিছুতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

সরকারিভাবে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। মানসিকভাবে উৎপীড়িত মানুষের জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে শহর ও গ্রামে যদি ক্রাইসিস ইন্টারভেনশন সেন্টার খোলা হয়, পাশাপাশি প্রতিটি হাসপাতালে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও সাইকোলোজিস্ট এবং সোশ্যাল ওয়ার্কার রাখা হয়, তাহলে অনেকাংশেই সঠিক সময়ে ভিক্টিম-নির্ণয় ও তাদের রোগনিরাময় করতে সুবিধা হবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং এবং প্রচারণার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সবার সচেতন হওয়া দরকার। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হতে হবে। সামাজিক সচেতনতা ও মানবিকতার বিকাশ ছাড়া আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়।

আত্মহত্যাকে ‘না’ বলতে হবে। জীবনকে ভালোবাসতে হবে। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর বুকে আমাদের আগমন কেবল একবার। সেই এক জনমকে ব্যর্থতা দিয়ে নয়, সফলতা দিয়ে পূর্ণ করে তুলতে হবে। যতক্ষণ নিজের আত্মবিশ্বাস প্রখর আছে, ততক্ষণ তিনি দুর্বল নন। জীবনটাই যুদ্ধক্ষেত্র। হারলেন কি জিতলেন, তা মুখ্য নয়। যোদ্ধা হয়ে বেঁচে থাকাটাই সাফল্য। সার্থকতা এখানেই।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর