বাংলাদেশের সত্য ও বাস্তব ইতিহাস হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধুর এই ডাকের কথা চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনের ওয়্যারলেস অফিস থেকে প্রথমে জানতে পারি। আমাদের বাসার পেছনে ছিল ওয়্যারলেস অফিস। কিছু পরে আমাদের সবাইকে মাইকে ঘোষণার মাধ্যমে পুলিশ লাইন ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়।
এই সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মেজর জিয়া, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরীসহ অন্য বাঙালি সামরিক অফিসাররা চট্টগ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
অপরদিকে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে একটি আকাশি রঙের হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এই হেলিকপ্টারটির আকাশে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য আমার মতো চট্টগ্রামের আরও অনেকে দেখেছেন।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের কথা জিয়াকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বললে তিনি নিজের নামেই ঘোষণা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা অপরিচিত মেজর জিয়া পরিস্থিতির সুযোগে হঠাৎ করেই নিজের নামে স্বাধীনতার কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাকে বাধা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করার জন্য বলেন। তিনি তখন তার ভুল স্বীকার করে পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
জিয়ার দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র হলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক সময় তিনি জেনারেল ওসমানীকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সেনাপ্রধান হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে যোগযোগ করেন। তিনি বলেন, জেনারেল ওসমানী নাকি বুড়ো হয়ে গেছেন। তাই তাকে সরিয়ে দিয়ে নতুনদের দায়িত্ব নিতে হবে। তার এই প্রস্তাব জেনারেল সফিউল্লাহ নাকচ করে দেন। এই ষড়যন্ত্রে তিনি সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। একথা জেনারেল সফিউল্লাহ আমার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
জিয়ার তৃতীয় ষড়যন্ত্র নিয়ে অনেকে বলে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নাকি তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করার একটি প্রস্তাব নিয়ে গোপনে আলোচনা করেন। জিয়ার এই ষড়যন্ত্রে খোন্দকার মোশতাকের ইশারা ছিল বলে জানা যায়। এ কারণেই নাকি যুদ্ধচলাকালে মোশতাককে সরিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।
জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে একজন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এ ব্যাপারে জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জিয়া ও আমি ব্যাচমেট। উনি মেধা তালিকায় আমার চেয়ে ১ নম্বর বেশি পেয়েছিলেন বলে তাকে অফিসার নাম তালিকায় সিনিয়র হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।’
জিয়া ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হন। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে জিয়া ১৯৭২ সালের জুন মাসে কুমিল্লার একটি ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং ওই বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। একাত্তরের মেজর জিয়াউর রহমান এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীতে দ্রুত প্রমোশনের মধ্যে দিয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল পদে আসীন হন।
মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের এত দ্রুত প্রমোশন পাকিস্তানফেরত বাঙালি সামরিক অফিসাররা কখনও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। যে কারণে সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও পাকিস্তানফেরত বাঙালি অফিসারদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
অনেকে বলে থাকেন এসব পাকিস্তানফেরত সামরিক অফিসাররাই সেসময়ের রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীতে অপপ্রচার চালায় এবং সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হওয়া সত্ত্বেও জিয়া এই অপপ্রচারে সক্রিয় ছিলেন বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানফেরত সামরিক অফিসারদের সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠতা অতীতের ষড়যন্ত্র তারই প্রমাণ করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিরা তাকে ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয় এবং মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করে। পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা এ সময় পাকিস্তানফেরত বাঙালি সামরিক অফিসারদের কর্তৃত্বে চলে আসে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন।
ক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়া সরাসরি কোনো জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে পরিকল্পিতভাবে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন শুধু ‘হাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে নিজেকে ক্ষমতায় আরও পাকাপোক্ত করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জিয়াকে সন্দেহের কারণে সেনাপ্রধান না করে সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়। জিয়া বঙ্গবন্ধু সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুণ্ন হন। আর এখান থেকেই তিনি শুরু করেন চক্রান্ত।
পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে পরোক্ষভাবে জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছিল বলে খুনিরা প্রকাশ্যে মিডিয়াতে স্বীকার করে। এভাবেই এক সময় প্রেসিডেন্ট সায়েমকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান।
ক্ষমতায় বসে জিয়াউর রহমান তার আসল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ করেন। জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই শাহ আজিজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে গিয়ে পাকিস্তানের সমর্থনে বক্তব্য রাখেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাপরিকল্পনার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে জিয়া কেন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি? বাধা দেয়া তো দূরের কথা উল্টো ওই সময় তিনি খুনিদের নীরব সম্মতি দেয়ার অভিযোগ আছে। পরবর্তীকালে খুনিদের রক্ষার্থে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার বন্ধ করে রাখার ইনডেমনিটি আইনকে সমর্থন করেন।
খুনিদের ঘোষিত বাংলাদেশ বেতারের বাংলা নাম ‘বাংলাদেশ বেতার’ থেকে পরিবর্তন করে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ নামকরণকে জিয়া কেন সমর্থন করলেন? জিয়ার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে জাতীয় সংসদে পাস করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হয়। শুধু তাই নয়, দালাল আইন বাতিল করে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকারদের বিচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক পাকিস্তানের নাগরিক জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে বিনা পাসপোর্টে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেন। খালেদা জিয়া তাকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। অথচ এই গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার্থে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন জিয়া। স্বাধীনতাবিরোধী কুখ্যাত রাজাকারদের নিজদলে ভিড়িয়ে এনে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে তৈরি করা ঐতিহাসিক ইন্দিরা মঞ্চকে জিয়া গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে শিশুপার্ক তৈরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে বাদ দিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান আবিষ্কার করেন। ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সড়কগুলোর নম্বর পরিবর্তন করে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়ককে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করেন।
বিএনপি এখন একটি ‘প্রতিষ্ঠিত’ রাজনৈতিক দল। অতীতের মিথ্যা ও কলঙ্কের ইতিহাস থেকে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণ বিএনপিকে দেখতে চায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তুলনাবিহীন নেতা, মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের একক নেতৃত্বদানকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দলকে সামনে নিয়ে যান। প্রয়োজনে কলঙ্ককিত নেতাদের পৃথক করে দলকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করুন।
বাংলাদেশের জনগণও চায় দেশে একটি সরকারবিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। পারবে কি বর্তমান বিএনপি জনগণের এই আশা পূরণ করতে?
লেখক: সুইডেনপ্রবাসী, কলাম লেখক।