বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

স্মরণ: তারিক আলী শ্রদ্ধাবরেষু

  • পপি দেবী থাপা   
  • ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:৫১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অগ্রসর হওয়া তারিক আলী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ’৭২-এর সংবিধানে প্রণীত চার মূলনীতির ধারায় রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা প্রতিটি বাঙালির পবিত্র দায়িত্ব। একটি আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনই ছিল তার আজীবনের লক্ষ্য ও সংগ্রাম।

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী কখনও জাতীয় সংগীত পুরোটা গাইতে পারতেন না। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াত কয়েক লাইন গাওয়ার পরেই। বিষয়টি তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সাবেক সাংস্কৃতিমন্ত্রী ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। তার উত্তর ছিল ‘জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাখো মানুষের মৃত্যু, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর জীবন দেওয়া, আরো কত মানুষের ত্যাগের সেই চিত্র।’

চোখের সমস্যার কারণে ১৯৭১ সালে অস্ত্রহাতে সম্মুখ সমরে যোগ দিতে পারেননি তারিক আলী। তাই বলে থেমে থাকার মানুষ ছিলেন না। প্রচলিত পথ যখন রুদ্ধ, জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মতো মানুষেরা নতুন পথ সৃষ্টি করেন। তিনি তাই করেছিলেন। প্রমাণ- মুক্তির গান। যোগ দিয়েছেন মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায়। রণাঙ্গনে যোদ্ধাদের জাগিয়ে তুলতে, উজ্জীবিত করতে, অনুপ্রেরণায় তারিক আলীর মতো তরুণদের ভূমিকা আজ ইতিহাসের অংশ। শুধু কি তাই? পাশে দাঁড়িয়েছেন শরণার্থীদের। এক কথায় তারেক আলীরা ছিলেন জয় বাংলার মুখ। সে সময় কারো অবদানকে খাটো না করেই বলা যায় ছিপছিপে রোগা চশমাপরা এক তরুণ অনায়াস নেতৃত্বগুণে নিজকাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এক দুরূহ দায়িত্ব। সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন যথাযথভাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজ করেছেন প্রাপ্তির প্রত্যাশা না রেখেই নীরবে।

’৭১-এ তার ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গেলেই ভাবখানা ছিল এমন, ‘কই এমন কিছু তো করিনি!’ নিজের ভূমিকা তার কাছে বড় ছিল না। তার চেয়ে অনেক বড় ছিল লাখো শহিদ আর স্বজনহারানো মানুষের কান্না। অবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি তাদের কথাই বলতেন, যাদের রক্ত আর বিসর্জনে স্বাধীন হয়েছে দেশ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অগ্রসর হওয়া তারিক আলী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ’৭২-এর সংবিধানে প্রণীত চার মূলনীতির ধারায় রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা প্রতিটি বাঙালির পবিত্র দায়িত্ব। একটি আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনই ছিল তার আজীবনের লক্ষ্য ও সংগ্রাম। বাংলা, বাঙালি আর বাংলা সংস্কৃতিতে জীবনাবদ্ধ আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক, বাঙালি তারিক আলী বিশ্বাস করতেন বাংলা সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই সংবিধানের চার মূলনীতিকে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে সংগীত শিক্ষা নেয়া তারিক আলী এ লক্ষ্য অর্জনে যুক্ত হয়েছেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে।

ভিতর-বাইরে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল একজন মানুষ তিনি। যেখানে অন্যায়, অত্যাচার আর মানবিকতা লঙ্ঘিত হয়েছে সেখানেই ছিল তার প্রতিবাদী অবস্থান। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, আদিবাসী কিংবা সুবিধাবঞ্চিত, নিগৃহীত মানুষের পাশে থেকেছেন আমৃত্যু।

সবাইকে নিয়ে একটি উন্নত প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। আর সে লক্ষ্যেই ছিল তার আজীবনের যাত্রা। ছিলেন ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’-এর সভাপতি। বনানী শারদীয় পূজামণ্ডপের অন্যতম উদ্যোক্তা। ২০০১-০২ সালে সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার সময় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ সংগঠনের অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।

কর্মজীবনে একজন বিশ্বমানের প্রকৌশলী তারিক আলী তার প্রতিটি কাজই দক্ষতা এবং দায়িত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করতেন। একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির কায়রো ও জাকার্তায় বিশ্বমানের ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ পরিচালনা করেছেন তিনি। অবসর গ্রহণের পরও চীনে কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্ল্যান্টের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। আমেরিকাতেও তিনি ছিলেন বাঙালি আর বাংলাপ্রেমী মানুষের অনুপ্রেরণা। সেখানে থেকেও করেছেন বাংলা গানের চর্চা। দেশের প্রতিটি জাতীয় দিবসে গান গাওয়া আর সে গান আমেরিকায় বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের শুদ্ধ করে শেখাতে দিনের পর দিন রিহার্সেল। কণ্ঠে উচ্চারিত গানে প্রকাশিত হয়েছে তার বিশ্বাস, দেশপ্রেম আর প্রগতিশীল স্বপ্নের বাংলার কথা।

তার কথা বলতে গেলে আলাদা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কথা বলতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী আটজন ট্রাস্টির অন্যতম ছিলেন তারিক আলি। সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হয়ে ওঠে তার সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে এই জাদুঘর। আগারগাঁওয়ে নতুন জাদুঘর নির্মাণকাজের তিনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়ক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিটি পরতে জড়িয়ে আছে এই অনন্য মানুষটির হাতের ছোঁয়া।

সত্য, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেমে দৃঢ়চেতা বিশাল হৃদয়ের মানুষটি কথা বলার সময় তার চোখে মুখে, প্রতিটি উচ্চারিত শব্দে যেন মুক্তিযুদ্ধের সেই নির্মম, নিষ্ঠুর দিনগুলোতে মানুষের করুণ চিত্র আর তার থেকে উঠে আসা এক জ্বালাময়ী চেতনার ছাপ বেরিয়ে আসত। মনে করিয়ে দিতেন কতটা মূল্য আমরা দিয়েছি স্বাধীনতার জন্য। তার কাছেই শিখেছি মুক্তিযুদ্ধ কেবল স্মৃতি রোমন্থনের বিষয় নয়। এই চেতনাকে ধারণ করে নিজেকে শাণিত করতে হয় প্রতিটি মুহূর্ত।

তিনি কোভিড পজিটিভ হওয়ার চার দিনের মাথায় তার সঙ্গে কথা হয়েছিল, বললেন, ‘আমি কোভিড পজিটিভ।’ শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। কী বলব শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

তারিক আলী ছিলেন সংগীতপ্রেমী, ছিলেন একান্ত রবীন্দ্রানুরাগী। প্রকৌশলী হিসেবে অনেক বেশি সম্ভাবনা ছিল তার। ছিলেন দক্ষ সংগঠক। কিন্তু এসব কিছুই তাকে প্রকাশ করে না। তার সম্বন্ধে বলা যায়, তিনি প্রকাশিত দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। এমন একজন মানুষ যার অস্তিত্বজুড়ে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নিশ্চিতভাবেই সময়ের সঙ্গে তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। জিয়াউদ্দিন তারিক আলী আপনি ঘুমান শান্তিতে, আপনার একাত্তর আমরা বয়ে নিয়ে যাব। আজ তার প্রথম প্রয়াণ দিবসে এ কামনা করে নিবেদন করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর