গেল সপ্তাহে যখন পশ্চিমা দেশগুলোর সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়ে, তখন কাবুলে বন্দুকের গুলি ছুড়ে তা উদযাপন করে তালেবান। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই তালেবান নেতাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। পুরো আফগানিস্তানকে (একটি প্রদেশ ছাড়া) কব্জায় আনার পরও তারা স্বস্তিতে নেই। সরকার গঠন, দেশ পরিচালনা তাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করার মনোবল ছাড়া তালেবানের তেমন কোনো যোগ্যতা-দক্ষতা নেই। দেশ পরিচালনার মতো যথেষ্ট জ্ঞানও নেই। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে আছে ‘জঙ্গি’ তকমা। এই পরিচিতি তাদের সবচেয়ে বড় সংকট। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ‘একঘরে’ করে রাখা হতে পারে। ফলে তাদের নিজের পথ নিজেদেরই দেখতে হবে। তালেবানের জন্য এটা যুদ্ধজয়ের চেয়েও অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি।
আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর নতুন সরকারের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে তালেবান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল ঘানি বারাদার এই সরকারের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। আরও দুই তালেবান নেতা মোল্লা মোহাম্মাদ ইয়াকুব ও শের আব্বাস স্ট্যানেকজাই, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকছেন বলে জানা গেছে। মোল্লা ইয়াকুব তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে। তিনি বর্তমানে তালেবানের সামরিক শাখার দায়িত্বে আছেন। অন্যদিকে শের আব্বাস স্ট্যানেকজাই কাতারে তালেবানের রাজনৈতিক দপ্তরের উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
সরকার গঠনের জন্য তালেবানকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করবে বলে বার বার ঘোষণা দিয়েছে। এখন সব গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের বাছাই করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও যে কেউ বিগড়াবে না౼ এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে যাদের নিয়েই সরকার গঠন হোক না কেন আফগানিস্তানে তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার হাতেই সর্বময় ক্ষমতা থাকবে বলে গণমাধ্যমে খবর এসছে।
এবার তালেবান বেশ ‘বড় ছাড়ের’ মানসিকতা নিয়েই পথ চলছে। তারা সরকারে আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০ বছর যাদের সঙ্গে লড়াই করেছে তাদেরও ক্ষমতার অংশী বানাতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি নাম উল্লেখ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। হামিদ কারজাই এবং আবদুল্লাহ আবদুল্লাহকে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা দিয়েছে, তাদের একজন হলেন তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গঠিত প্রথম সরকারের প্রেসিডেন্ট। আর দ্বিতীয়জন হলেন ক্ষমতাচ্যুত আশরাফ ঘানি সরকারের দুই নাম্বার ব্যক্তি।
তারা হেরাতের সাবেক গভর্নর ইসমাইল খানকে ক্ষমা করে দিয়ে তালেবানে যোগ দিতে অনুমোদনই করেনি তাকে ভবিষ্যৎ আফগান সরকারের অংশ করতে যাচ্ছে। অথচ এই খান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তালেবানের বিরুদ্ধে হেরাতে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি আর ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহকেও ক্ষমা করে দিয়ে তাদের প্রতি দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। আশরাফ ঘানির ভাই তো তালেবানে যোগ দিয়েছে। তবে তালেবান সরকার গঠনে যত ছাড়ই দিক, নতুন সরকার যেমনই হোক, যাদের নিয়েই হোক, এই সরকারের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন।
তালেবানবিরোধী গ্রুপগুলোকে বাগে আনাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখনও পানশির উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। এখনও তালেবান এই প্রদেশের দখল নিতে পারেনি। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকার গড়লেও কি তালেবান আফগানিস্তানে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ আগানিস্তানে শান্তি ফিরবে?
আফগানিস্তানের ইতিহাস বলছে এই প্রশ্ন, এই সংশয় অমূলক নয়। আফগানিস্তানে ১৩-১৪টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। যার মধ্যে পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, তুর্কমেনি ও বালুচিসহ এমন অন্তত ৬-৭টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সব সময়েই থেকেছে আফগান রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। এরা যেমন আফগানিস্তানে সোভিয়েত জমানাতেও নিজেদের ওজন ধরে রেখেছিল, তেমনই নিজেদের জায়গা বুঝে নিয়েছিল ২০০১ সালের পর থেকে আমেরিকার হাতে চলে যাওয়ার সময়েও। বিভিন্ন প্রদেশে অন্তত কয়েক জন ‘ওয়ার লর্ড’ বা যুদ্ধসম্রাটের জন্যই এই জাতিগোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে। তাই ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবান গোটা আফগানিস্তানে দাপিয়ে বেড়ালেও তাজিক অধ্যুষিত পানশির উপত্যকার মাথা নোয়াতে পারেনি।
পুরো আফগানিস্তানে তালেবানের নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। কারণ তারা মূলত যে জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, সেই পশতুনরাই আফগানিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মোট জনসংখ্যার (প্রায় ৪ কোটি) ৪২ শতাংশ। কিন্তু পশতুনরাও সব সময় তালেবানের পাশে থেকেছে, এমন নয়। যাকে হটিয়ে তালেবান এবার কাবুলের ক্ষমতা দখল করল, সেই পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ও তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও পশতুন জাতিগোষ্ঠীরই নেতা। সুন্নি হলেও মূলত দক্ষিণ ও পূর্ব আফগানিস্তানে প্রভাব খুব বেশি থাকা পশতুনদেরও পুরোপুরি তাদের পাশে পাওয়ার আশা করে না তালেবান। তার কারণ, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের মতো জনাকয়েক পশতুন যুদ্ধসম্রাট। যারা তালেবানের কাছে মাথা নুইয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে দিতে চাইবেন না।
এর পরেই রয়েছে তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠী। আফগানিস্তানে মোট জনসংখ্যার ২৬-২৭ শতাংশ তাজিক আর ১০ শতাংশ হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই দুই জাতিগোষ্ঠীই কখনও তালেবানের কাছে মাথা নোয়ায়নি। পানশির উপত্যকাসহ গোটা উত্তর আফগানিস্তান, বাদাকশান ও আফগানিস্তানের পশ্চিম দিকের একটি বড় অংশ রয়েছে তাজিকদের নিয়ন্ত্রণে। এরাই তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নয়ের দশকে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোট গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে তাজিক নেতা প্রেসিডেন্ট বুরহাউদ্দিন রব্বানিকে সরিয়ে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তালেবান। এখন আহমেদ মাসুদের মতো তাজিক নেতা তালেবানের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপর আগের জমানায় নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল তালেবান।
শিয়া সম্প্রদায়ের হাজারাদের স্কুল, বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। মধ্য আফগানিস্তানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিসহ হাজারাদের অনেক স্থাপত্য নষ্ট করা হয়।
উজবেকিস্তান সীমান্তে উত্তর আফগানিস্তানে থাকা উজবেক জাতিগোষ্ঠীও তালেবানদের খুব একটা মান্য করে না। তারা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হলেও তালেবানের বিরুদ্ধে বরাবরই গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ। তাদেরই অন্যতম যুদ্ধসম্রাট আবদুল রশিদ দস্তুম। তুর্কমেনিস্তান সীমান্তে থাকা আফগানিস্তানের তুর্কমেনিরাও কখনও তালেবানের আধিপত্য মানতে চায়নি। তারা উত্তরের জোটের বড় শক্তি হয়ে থেকেছে বরাবরই। আর পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ লাগোয়া আফগানিস্তানের বালুচিরা কখনই তালেবানকে রেয়াত করেনি। তারাও বরং সঙ্গে থেকেছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সেরই।
তালেবানের মধ্যে সংখ্যাধিক্য যাদের, সেই পশতুনদের যুদ্ধসম্রাট হিসেবে যথেষ্টই খ্যাতি রয়েছে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের। যিনি এক সময় আমেরিকার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন পাকিস্তানের আইএসআই-এর ‘হাতের পুতুল’। তালেবানকে পছন্দ করেন এমন পরিচিতি নেই হেকমতিয়ারের।
তালেবানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়াই করবেন যিনি, তিনি তাজিক নেতা আহমেদ মাসুদ। পানশির উপত্যকায় তারই নেতৃত্বে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন তাজিকরা। রয়েছেন উজবেক নেতা আবদুল রশিদ দস্তুমও। কট্টর তালেবান-বিরোধী বলেই যার পরিচিতি।
এতসব বিদ্রোহী গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে এনে গৃহযুদ্ধ থামানো তালেবানের জন্য সহজ কাজ নয় মোটেই। তবে গৃহবিবাদের অবসান ঘটানোর চেয়ে তালেবানের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি হলো, আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে সামাল দেয়া এবং সামনে এগিয়ে নেয়া। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশি রিজার্ভ আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার পথ ধরে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক গ্রুপও দেশটির জন্য অর্থ ছাড় স্থগিত করেছে। অন্য পশ্চিমা দেশগুলোও যে এর পথ ধরবে তাতে সংশয়ের কোনো কারণ নেই।
আফগানিস্তানের অর্থনীতির আকার এখন ২২ বিলিয়ন ডলারের। প্রশ্ন হলো- দেশটিতে আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতিশীল কার্যক্রম চালু করতে কতটা সক্ষম হবে নতুন সরকার? তারা কি পারবে উন্নয়ন সহায়তাকারীদের আস্থা অর্জন করতে এবং রাষ্ট্রের খনিজসম্পদে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে সেটিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে কাজে লাগাতে?
তালেবান নিয়ে সবচেয়ে বড় সংশয় তাদের বিশ্বাস, মানসিকতা ও অতীত কর্মকাণ্ড। তারা যদি গোঁড়ামি ত্যাগ না করে, নিজেদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড দিয়ে জঙ্গি পরিচয় মুছে ফেলতে উদ্যোগী না হয় তাহলে মূল্য গুনতে হবে। আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্বের কালে কিছু মানুষ গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। নারী স্বাধীনতার পথে কিছুটা হলেও এগিয়েছে। এখন ধর্মাশ্রয়ী তালেবান শাসক যদি পুরনো ধ্যানধারণাকেই আঁকড়ে থাকে তাহলে আফগানিস্তানের অন্ধকার ঘুচবে বলে মনে হয় না। ধর্মীয় নেতা যদি শাসক হয়, তাহলে ধর্মের অনুশীলন নয়, ধর্মতন্ত্র গড়ে ওঠে। আইন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে ধর্মতন্ত্রের একটি বাঁধনে বাঁধতে চাইলে তা নিগ্রহে পরিণত হতে বাধ্য। ধর্মতন্ত্রীদের সুশাসক হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ধর্মের নিয়মেই, কারণ “ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন শুধু মারে আর মরে।”
লেখক: প্রবন্ধকার, কলাম লেখক ও সাবেক ছাত্রনেতা