করোনা পুরো পৃথিবীকেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, বিশ্ব কখনোই আর করোনা পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাবে না। করোনা শেষে বদলে যাওয়া বিশ্বে নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে সবাইকে। তবে বিশ্ব কবে করোনামুক্ত হবে সেটা কেউই জানেন না। করোনা সব খাতেই আঘাত করেছে। সবাই কোনো না কোনাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সব খাতই আসলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সব খাতই করোনার অভিঘাত সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার নানারকম পরিকল্পনা করছে। তবে শিক্ষা খাতে করোনার যে ক্ষতি তা হয়তো কোনোদিনই পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সামনের দিকে আছে। ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ এক যৌথ বিবৃতিতে অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে আগেই। তাদের সে বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে সবার পরে, খুলবে সবার আগে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে উলটো।
গতবছর ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনারোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর মধ্যে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন- নানা কিছু হয়েছে। অফিস-আদালত বন্ধ হয়েছে, খুলেছে, আবার বন্ধ হয়েছে, আবার খুলেছে। সর্বশেষ পর্যটন কেন্দ্রগুলোও খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই আছে। এ বছরের শুরুর দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর খোলেনি।
এবার আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরও এক দফা বাড়িয়ে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে বটে, তবে খোলার প্রস্তুতিও চলছে। ১৫ অক্টোবরের পর প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়, পরে ধাপে ধাপে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনা এবার বাস্তবায়ন করা যাবে বলে আশা করা যায়।
আগেই বলা হয়েছে, অন্য সব খাত পুষিয়ে নেয়া গেলেও শিক্ষার যে ক্ষতি তা কখনই পুরোপুরি পুষিয়ে নেয়া যাবে না। তবু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পাশাপাশি ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনাটাও করতে হবে ভালোভাবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে প্রায় ১৮ মাস। এই সময়ে অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্তি রাখার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে কিছুটা মিটলেও ক্লাসরুমের অনুপস্থিতি অনলাইনে পোষানো কখনোই সম্ভব নয়। অনেকগুলো পাবলিক পরীক্ষা জট লেগে গেছে। গতবছর অটোপাস হলেও এবার এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা আছে। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনায় বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার ক্ষতি টাকা দিয়ে মাপা যায় না। তবু ইউনিসেফের ধারণা, গোটা বিশ্বে পুরো প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। আর্থিক ক্ষতি হয়ত পুষিয়ে নেয়া যাবে, তবে একটা প্রজন্ম শিক্ষার যে ঘাটতি নিয়ে বেড়ে উঠছে; তা কখনই পোষানো যাবে না।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ক্ষতিটা বহুমুখী এবং বহুমাত্রিক। এমনিতেই আমাদের দেশে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। তাতে শিক্ষা খাতে বৈষম্য রাষ্ট্রের সমান্তরাল। তবে করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারলেও গ্রামের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হলে একটি স্মার্ট ডিভাইস লাগবে, লাগবে ইন্টারনেট সংযোগ। গ্রামে অনেকের জন্য সেটা মহার্ঘ্য। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই বৈষম্য কতটা কমিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো- সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনা।
১৮ মাসের বন্ধে শিক্ষার্থীদের অনেকেই নানা কাজে-কর্মে যুক্ত হয়ে গেছে। অনেক শিশু-কিশোর নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে গেছে। নারী শিক্ষার্থীদের অনেকের বাল্যবিয়ে বা আগাম বিয়ে হয়ে গেছে। তাই সবাইকে ফিরিয়ে আনা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও। তবে কত বেশি শিক্ষার্থীকে আবার ক্লাসে ফেরানো যায়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোটা কত জরুরি।
আগেই বলা হয়েছে, করোনাপূর্ব বিশ্বে আমরা আর কখনই ফিরে যেতে পারব না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলাম আর শিক্ষার্থীরা ক্লাস করা শুরু করে দিল; সব ঠিক হয়ে গেল; ব্যাপারটা অত সহজও নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানানো, সামাজিক দূরত্ব, পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, মাস্ক পরানোর অভ্যাস করা তো আছেই কাজ করতে হবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও। করোনা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাদের দৈনন্দিন রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার জন্য সকালে ওঠার অভ্যাস এতদিনে নষ্ট হয়ে গেছে।
অনলাইন ক্লাসের জন্য পাওয়া স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত হয়ে গেছে অনেকে। নানা রকম বিপজ্জনক গেমেও আসক্তি এসেছে কারো কারো। রাতভর জেগে থাকা, দিনভর ঘুমানোর অভ্যাস হয়েছে কারো কারো। এসব নেশা কাটিয়ে সবাইকে স্বাভাবিক রুটিনে আনা সহজ নয়। নতুন শিক্ষার্থীদের অনেকে ক্লাসরুম কী জিনিস দেখেইনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। এতদিন পর ক্লাসে ফিরে কেউ খিটখিটে আচরণ করতে পারে, কারো ক্লাস করতে ভালো না-ও লাগতে পারে, কেউ একা থাকতে চাইতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।
তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরিকল্পনার পাশাপাশি তাদের শিক্ষাঘাটতি পুষিয়ে নেয়, বৈষম্য কমানো, শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য- সবগুলো বিষয়ই মাথায় রাখতে হবে। এই শিক্ষার্থীরাই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ। তাই জাতির স্বার্থেই এই শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সম্পদ হিসেবে।
লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক