বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে নারী-পুরুষ মিলিয়ে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এদের মধ্যে শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬ কোটি ৮ লাখ। আবার কর্মক্ষম কিন্তু কাজ নেই– এমন বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। অর্থাৎ দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
২০১৭ সালের পর বিবিএসের আর কোনো শ্রমশক্তি জরিপ হয়নি।
করোনা ও দফায় দফায় লকডাউনের দেশে একদিকে প্রায় দেড় বছর ধরে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সব ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ।
অন্যদিকে করোনা ও লকডাউনের বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নেতিবাচক প্রভাবে দেশে শিল্প খাতে উৎপাদন ও সেবা সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাধাগ্রস্ত হয়েছে আমদানি-রপ্তানি। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে গেছে।
পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নিয়োগ তো দূরের কথা, উলটো কর্মীদের ছাঁটাই করছে। এ ছাড়া চাকরির বাইরে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো খাতে সম্পৃক্ত থেকে আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগে ছিল, তাদের অনেকেই সক্ষমতা হারিয়ে বেকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। নতুন শিক্ষার্থীরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বেকারের তালিকায়। শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু চাকরির সুযোগ হয়নি। এতে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতের পাশাপাশি দক্ষ-অদক্ষ বেকারের হারও এই সময়ে ঊর্ধ্বমুখী।
সব মিলিয়ে দেশে বেকারের মিছিল দীর্ঘ হয়েছে সবাই এমনটা ধারণা করলেও আক্ষরিক অর্থে এখন বেকারের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার হাতে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা তথ্য বলছে, দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণের এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ পুরোপুরি বেকার। আর ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।
শ্রমবাজারসংক্রান্ত বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ আরও বলছে, প্রতিবছর দেশে ১৮ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) দাবি করছে, এ সংখ্যা ২০ লাখের কম নয়।
এ দিকে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ) জানিয়েছে, প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে সংখ্যক লোক প্রবেশ করছে, তাদের মধ্যে সরকারি খাত কর্মসংস্থানের জোগান দিচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশ, বাকি ৯৬ শতাংশেরই কর্মসংস্থান ঘটছে বেসরকারি খাতে, যেখানে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি খাতের অবদান ৮০ শতাংশের বেশি। বাকি অংশ কাজের খোঁজে যাচ্ছে বিদেশে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সাবেক সভাপতি কামরান টি রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে কাজের উৎস্য দুটি: প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৮৫ লাখ লোক কাজ করছে। এর বিপরীতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে এমন লোকের সংখ্যা ৫ কোটি ২৩ লাখেরও বেশি। তবে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে, তাদের বেশির ভাগেরই চাকরির অনিশ্চয়তা, অপেক্ষাকৃত কম বেতন-ভাতা এবং সেটিও নিয়মিত পাওয়ার অনিশ্চয়তা আছে। মূলত এসব কারণেই প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরিপ্রত্যাশীদের ঝোঁক বেশি। তাই কর্মপ্রত্যাশায় উদ্গ্রিব বেকাররা একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তির আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে শ্রমবাজারের দিকে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. নাজনীন আহমেদ এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে জানান, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বই একটা ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরই প্রভাব পড়েছে সরকারি কিংবা বেসরকারি অর্থাৎ দেশের পুরো শ্রমবাজারে। পরিস্থিতিটাই আসলে প্রতিকূল। প্রতিটি নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া আছে। এই পরিবেশে চাইলেই তো কিছু জায়গায় এখন নিয়োগটা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের রেগুলার নিয়োগে যেমন কিছুটা সমস্যা হয়েছে, একইভাবে বেসরকারি খাতেও সেই সমস্যা হয়েছে। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। একই সঙ্গে ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
সরকারি চাকরির যে অবস্থা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ১৫ জুন প্রকাশিত সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস, ২০২০’ এর তথ্য মতে, দেশে এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মোট অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি। এর মধ্যে বর্তমানে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩ জন কর্মরত অবস্থায় সরকারি বেতন-ভাতার সুবিধা ভোগ করছেন। যেখানে নারী রয়েছেন ৪ লাখ ১৪ হাজার ৪১২ জন।
অর্থাৎ অনুমোদিত পদের বিপরীতে দেশে সরকারি চাকরিতে শূন্য পদ ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি। প্রথম শ্রেণির ৪৬ হাজার ৬০৩টি ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৩৯ হাজার ২৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণির শূন্য পদ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ৯৯ হাজার ৪২২টি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি চাকরির লোভনীয় পদগুলোর (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়া হয় সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর কিংবা বিভাগ নিজেদের মতো করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে নিয়োগ দেয়। এর বাইরে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) নিয়োগ দিয়ে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পদে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছর চার মাসে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে ৯৯ শতাংশেরও বেশি নিয়োগ অসম্পন্ন থেকে গেছে। করোনার কারণে এসব নিয়োগ আটকে গেছে অথবা নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়া কিংবা মামলা জটিলতাসহ নানা কারণে সম্পন্ন করা যায়নি।
এতে করে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। একটি চাকরির আশায় দিন পার করতে গিয়ে ইতিমধ্যে দেশের প্রায় দেড় লাখ চাকরিপ্রত্যাশীর আবেদনের বয়স শেষ হয়ে গেছে বা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন তথ্য মতে, ৪১তম বিসিএসে আবেদন করে পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে পৌনে ৫ লাখ বেকার। এর বাইরে শুধু খাদ্য অধিদপ্তরের ১৬৬টি পদের বিপরীতে নিয়োগ আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ১৪ লাখ। প্রায় পৌনে ৭ লাখ বেকারের আবেদন জমা পড়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন সমাজকর্মী হওয়ার আশায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ১৪১টি পদে নিয়োগ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন ২ লাখের বেশি প্রার্থী। এর বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪ হাজার ৭৫০টি পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করে পরীক্ষার অপেক্ষায় আছেন ৬ লাখের বেশি প্রার্থী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ) মো. লাইসুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এ কারণে সরকারি নিয়োগের বেশ কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি। তবে থেমেও ছিল না। করোনার মধ্যেই স্বাস্থ্য খাতে ডাক্তার, নার্সসহ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে দু-একটি পদের বিপরীতে কিছুসংখ্যক প্রার্থীর নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে, যেগুলো আটকে আছে, সেগুলোও নিয়োগের প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে।’
সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের হার কী পরিমাণ বেড়েছে, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা জানান, গত ১০ বছরে প্রায় ১০ লাখ নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে।
নতুন সৃষ্টি করা পদগুলোয় কী পরিমাণ নিয়োগ হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসনের কাজ পদ সৃজন করা। আগে যে কোনও নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হতো, সম্মতি নেয়া হতো। এখন সেটি হয় না। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজেরাই নিজেদের মতো করে নিয়োগ দেয়। বিচ্ছিন্নভাবে নিয়োগ হয় বলে নতুন কত নিয়োগ হলো, সেটি মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। তবে লকডাউন প্রত্যাহার হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চলেছে। নিয়োগ প্রক্রিয়াও ধীরে ধীরে শুরু করা হচ্ছে। চাকরিপ্রত্যাশীরা অচিরেই এর সুফল পাবে।’
কী অবস্থা বেসরকারি খাতে
করোনাকালে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি নতুন চাকরিও ব্যাপক হারে কমেছে। গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলেও চলতি বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এমন অবস্থায় গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার নিষেধাজ্ঞা (লকডাউন) জারি করে, যা শেষ হয় গত ২৩ জুলাই। আবারও লকডাউনে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে এখন গত কয়েক দিন ধরে আবারও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বেসরকারি খাত।
কিন্তু গত প্রায় দেড় বছরে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বেসরকারি খাত। এতে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে চাকরির বাজার। বন্ধ রয়েছে নতুন নিয়োগ। অনেক কোম্পানি তাদের পুরাতন কর্মীদের ছাঁটাইও করেছে। ফলে বেড়েই চলেছে কর্মহীনদের সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেকারত্বের সংকট আছে। এটা দিন দিন বাড়ছে। সরকার স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ রেখে এটাকে একটু কম দেখাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন তারা এখনও পরীক্ষা দিচ্ছেন। প্রতিবছর ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে আসছে। সেটা হয়তো এখন ৪০-৫০ লাখে দাঁড়িয়েছে। নতুনভাবে চাকরিচ্যুত হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের একটা বিশাল সমস্যা তৈরি হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার বলছে বেকারত্বের হার ৪ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে, আমরা ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে ভালো আছি। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা করতে হলে আগে প্রকৃত বেকারত্বের চিত্র তুলে আনতে হবে। এরপর পরিকল্পনা ধরে এগোতে হবে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা তথ্য মতে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরি করে এমন ১৩ ভাগ মানুষ করোনায় কাজ হারিয়েছেন। তবে চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই, এমন মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। আর ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। সব মিলিয়ে করোনার প্রভাবে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে স্বল্প মেয়াদে কর্মসংস্থান হারাবে ১১ লাখ তরুণ। আর দীর্ঘ মেয়াদে এ সংখ্যা ১৬ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাতটি খাতে বেশি কাজ হারানোর আশঙ্কার উল্লেখ করে বলা হয়, এসব খাতে কাজ হারাতে পারে কর্মক্ষম যুবকদের ৭৫ দশমিক ৯ শতাংশ। খাতগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি খাতে কাজ হারানো তরুণদের হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশ, নির্মাণ খাতে কাজ হারাতে পারে এমন তরুণের হার ১২ দশমিক ৮ শতাংশ, বস্ত্র ও পোশাক খাতে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ও খুচরা বাণিজ্যে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ২ দশমিক ৬ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ পরিবহন খাতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য সেবা খাতে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের হিসেবে করোনার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার পোশাক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সাবেক সভাপতি কামরান টি রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ঠিক, করোনায় দফায় দফায় লকডাউনের কারণে বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা বন্ধ ছিল। উৎপাদনে থাকলেও শতভাগ সক্ষমতা ছিল না। এতে শিল্প পরিচালনায় সমস্যা ছিল। ফলে লোকজনও বেকার হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে করোনার কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বেকার হয়েছে।
‘তবে এটাও শুনতে পাই, পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের অন্তত ৭০ শতাংশই আবার কাজে ফিরে এসেছে। কিন্তু যারাই ফিরে এসেছে, তাদের বড় একটা অংশ আগের কাজে ফিরতে পারেনি। তারা পেশা পরিবর্তন করেছে। যারা উৎপাদন ও সেবা খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল কেউ কেউ কৃষিকাজে যোগ দিয়েছে। এ কারণে তাদের আয়েও পরিবর্তন এসেছে।’
সংকটের কথা স্বীকার করলেও ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ দাবি করেন, ‘শ্রমবাজারে মহাপ্রলয় ঘটে যাওয়ার মতো এমন কোনো কিছু হয়নি। প্রতিবছর ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বলে করোনার কারণে কারো চাকরি হয়নি, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না তা নয়। প্রতিবছর এমনিতেই ১৩-১৪ লাখ নিয়োগ হয়। এর বাইরে বিদেশ যায় ২-৩ লাখ। তবে অবশ্যই এবার কিছুটা কম হয়েছে। কিন্তু কত কম হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনও নেই।’
ড. নাজনীন দাবি করেন, ‘সব জায়গা কিন্তু বন্ধ ছিল না। কৃষি খাতে নিয়োগ হয়েছে। যেসব খাত ভালো করছে, যেমন আইটি সেক্টর, টেলিকম, ই-কমার্স খাত, ফার্মাসিউটিক্যালস, সেখানেও নিয়োগ হয়েছে। আমাদের গ্রোথ হয়েছে। যখন ইকোনমিতে গ্রোথ হয়, তখন বুঝতে হবে সেখানে নিশ্চয়ই নেতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। অতিদরিদ্র মানুষ কাজে ফেরত এসেছে। তারা বসে নেই। লকডাউনেও কাজ করেছে। সমস্যা কিছুটা হয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্তের।’
জট খুলবে না গণটিকা ছাড়া
বিশ্ব থেকে করোনা সহজে যাবে না। কিছুদিন পর পর লকডাউন দিয়েও করোনা মোকাবিলা সম্ভব হবে না। আগামী কয়েকটি বছর করোনাকে সঙ্গী করেই আগামীর পথে হাঁটতে হবে। বাংলাদেশকেও এর বাস্তবতা মেনে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সাবেক সভাপতি কামরান টি রহমান মনে করেন, ‘আগের অবস্থায় ফিরে আসতে হলে শিল্প-কারখানার স্বাভাবিক উৎপাদন করতে হবে। এর জন্য লকডাউন থেকে বেরিয়ে মানুষের চলাফেরা স্বাভাবিক রাখতে হবে। সবাইকে ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনতে হবে। এগুলো করা না গেলে শ্রমবাজারের পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি আশা করা যায় না।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত না লকডাউন যাবে এবং মানুষকে ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে, তত দিন শ্রমবাজার পরিস্থিতির তেমন উন্নতির সম্ভাবনা দেখছি না।’
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘যে সময়টা পার করছি, সেটি মেনে নেয়ার বিষয় আছে। তবে সরকারে প্রকল্পগুলো যদি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়, ভ্যাক্সিনেশনটা হয়ে যায়, তাহলে আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসব। তখন চলমান সংকটেরও উত্তরণ সম্ভব হবে। তাই আমি বলব, সরকারের আগামী দিনের কর্মকাণ্ডের মূল ফোকাস হওয়া উচিত ভ্যাক্সিনেশন ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি।’