বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেরিনার হওয়ার আগে জেনে নিন

  •    
  • ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৭:২৪

বিদেশি জাহাজ কোম্পানিতে স্কলারশিপ পান হাতেগোনা ১০/১৫ জন ক্যাডেট। বাকি সব ক্যাডেটের ভরসা দেশি কোম্পানিগুলো। ২০১০-২০১২ সালের পর দেশি কোম্পানির জাহাজসংখ্যাও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, ফলে ক্যাডেট এবং অফিসারদের চাকরির সুযোগও কমেছে।

মেসেঞ্জারে প্রায়ই অনেক অপরিচিতদের মেসেজ পাই, যারা মেরিনার হতে চান। কেউ বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে ভর্তির বিষয়ে পরামর্শ চান, কেউ মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা সম্পর্কে জানতে চান।

মেরিনার বা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের জ্ঞান খুবই অগভীর। এখনও মেরিন অফিসার আর নেভি অফিসারের মধ্যে পার্থক্য অনেকে গুলিয়ে ফেলেন।

আমি যখন ২০১০ সালে এইচএসসি পাশ করি, তখন ‘মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি’ কোচিংয়ের বিজ্ঞাপনে কতগুলো পয়েন্ট উল্লেখ করা হতো। যেমন-

১. এটা চ্যালেঞ্জিং প্রফেশন

২. একজন মেরিনার একজন অ্যাম্বাসেডর

৩. বিনা মূল্যে বিশ্বভ্রমণের সুযোগ

৪. মাত্র ৬-৮ বছরে ক্যাপ্টেন/চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ১০ হাজার ডলারের বেশি বেতন

৫. স্বল্প সময়ে স্টাব্লিশড হওয়ার সুযোগ

১, ২, ৩ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। সমস্যা হচ্ছে ৪ আর ৫ নম্বর নিয়ে। হয়ত এক যুগ আগে ৪, ৫ পয়েন্ট নিয়েও কোনো দ্বিমত ছিল না, তবে এখন খুব জোরালোভাবে দ্বিমত করা যায়।

উপরের পয়েন্টগুলো দেখে এইচএসসি পাশ করা এক জন ছেলের (এখন মেয়েদেরও ভর্তির সুযোগ আছে) মাথা ঘুরে যাওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক।

তারা ভাবে হাজার ডলার বেতন পেয়ে বাবা-মা, ভাই-বোনের সব স্বপ্ন পূরণের জন্য মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দূর হয়ে যাবে সব কষ্ট।

এ কারণে বাবা-মা জমি বিক্রি করে/বন্ধক রেখে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে হলেও ছেলেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান। মেরিনারদের নিয়ে যত স্বল্প ধারণাই থাকুক না কেন, সবাই ভাবেন মেরিনার মানেই টাকা! ডলার!

তবে আসলে যে কত টাকা আর কত ডলার বেতন বর্তমানে দেয়া হয়, সে বিষয়টি জানার চেষ্টা কেউ করেন না। শুধু ডলারে বেতন শুনেই তাদের অন্তর জুড়ায়।

আমাদের সময়ে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিংয়ের প্রসপেক্টাসে লেখা হতো, ক্যাডেটদের মাসিক বেতন ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার! অর্থাৎ পাসিং আউটের পরে জাহাজে পা রাখলেই ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। যেখানে আমাদের অভিভাবকেরা বহু বছর চাকরি করে এই টাকা বেতন পান, সেখানে ক্যারিয়ারের শুরুতেই একজন মেরিন ক্যাডেটের বেতন তাদের সমান বা বেশি!

তবে এটা হলো প্রসপেক্টাসের হিসাব। ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার পাওয়া ক্যাডেট যে নেই তা নয়, কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্যাডেটের ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য হয় না।

বিদেশি জাহাজ কোম্পানিতে স্কলারশিপ পান হাতেগোনা ১০-১৫ জন ক্যাডেট। বাকি সব ক্যাডেটের ভরসা দেশি কোম্পানিগুলো। ২০১০-২০১২ সালের পর দেশি কোম্পানির জাহাজ সংখ্যাও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, ফলে ক্যাডেট এবং অফিসারদের চাকরির সুযোগও কমেছে।

বোঝার জন্য বলছি, ধরুন ৮০টি জাহাজে যদি ১৬০ জন ক্যাডেট নেয়া যায়, তাহলে ৪০টি জাহাজে ক্যাডেট নেয়া যাবে তার অর্ধেক। ২০১৩-এর পর এটাই মূল সমস্যা হয়েছে। জাহাজের সংখ্যা কমেছে, কিন্তু ক্যাডেট পাস আউট হয়েছে চাহিদার দ্বিগুণ। ফলে আমাদের পরের ব্যাচগুলোর অনেক জুনিয়রকে জাহাজে জয়েন করতে দুই-তিন বছরও অপেক্ষা কর‍তে হয়েছে।

আরেকটা বড় সমস্যা হলো, ক্যাডেট (ট্রেইনি) প্রতি জাহাজে দুই থেকে চার জন করে নেয়ার সুযোগ থাকলেও অফিসার র‍্যাংকে এক জনের বেশি নেয়া হয় না। মানে ৮০টি জাহাজে ৮০ জন ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার বা থার্ড অফিসার থাকবেন। সে হিসেবে একই সঙ্গে ক্যাডেটশিপ শেষ করা কয়েক জন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে একসঙ্গে একই জাহাজে উঠতে পারবেন না! এই সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন আগের ব্যাচ থেকে অপেক্ষারত সিনিয়রেরা।

আমি বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ৪৭তম ব্যাচের একজন ক্যাডেট। আমাদের ব্যাচে সারা বাংলাদেশ থেকে ২০০ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। আমরা ক্যাডেটশিপ মোটামুটি ভালোভাবে শেষ করতে পারলেও অফিসার হিসেবে জয়েন করতে পারছি না অনেকেই।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে বের হয়ে ২০২০ সালে এসেও ২০০ জনের সবাই জুনিয়র অফিসার হতে পারিনি। অথচ প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, এর মধ্যে আমাদের ক্যাপ্টেন/চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ১০ হাজার ডলারের বেশি বেতন পাওয়ার কথা!

এবার বর্তমানে বেশির ভাগ ক্যাডেট আর জুনিয়র অফিসারদের বেতন নিয়ে একটু ধারণা দিই। জেনে অবাক হবেন, কয়েক বছর আগেও দেশি কিছু কোম্পানিতে কোনো বেতন ছাড়াই ক্যাডেটদের জাহাজে কাজ করানো হয়েছে। ক্যাডেটদের শুধু তিন বেলা খাবার আর অভিজ্ঞতার জন্য ‘কাবিখা’ (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) গ্রুপে নাম লেখাতে হয়েছিল!

বেশির ভাগ দেশি কোম্পানিতে ক্যাডেটদের বেতন ১৫০ থেকে ৩০০ ডলার। এভাবে এক-দেড় বছর বসে থেকে জাহাজে জয়েন করে অফিসার হওয়ার পরীক্ষা দিতে আবার লাখ তিনেক টাকার জোগান দিতে হয়, যা পরিবার থেকে না নিয়ে উপায় থাকে না। এই পরীক্ষার ঝামেলা শেষ করে অফিসার হিসেবে জয়েন করতে আরও বছরখানেকের অপেক্ষা।

অনেকে আবার পরীক্ষা শেষে সমুদ্রগামী জাহাজে জয়েনিংয়ের সুযোগ না পেয়ে কোস্টাল শিপে চাকরি করছেন কেবল পরিবারের খরচ চালাতে, কারণ কোস্টাল শিপে চাকরি করলে সেই অভিজ্ঞতা পরে সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। এমনকি পরবর্তী ধাপের পরীক্ষাও দেয়া যায় না কোস্টাল জাহাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে।

সমুদ্রগামী দেশি কোম্পানির জাহাজে ট্রেইনি জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার/অফিসারদের বেতন ৩৫০ থেকে ৫০০ ডলার! দিনে মাত্র ১২ থেকে ১৬ ডলার, ডিউটি টাইম অন্তত ১০ ঘণ্টা। পাসিং আউটের ৩/৪ বছর পর মেরিন অফিসার হয়ে ডলারে বেতন পাওয়ার স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছে- সেটিই তখন একমাত্র সান্ত্বনা।

এরপর আরও ৮/১০ মাস পর ট্রেইনি অফিসার থেকে ভালো পারফর্ম করে পুরোপুরি অফিসার হিসেবে জয়েন করতে কত সময় লাগবে সেটি অনিশ্চিত। অফিসার হবার পরেও বেতন হবে প্রসপেক্টাস এবং প্রত্যাশার চেয়ে অনেক অনেক কম, সেই সঙ্গে জয়েনিং ডিলে তো আছেই।

ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে উপরের ৪ আর ৫ নম্বর পয়েন্ট যে ফাঁকা বুলি সেটি আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

এই পেশায় ভারতীয় আর ফিলিপিনোরা সংখ্যাগতভাবে এগিয়ে আছে। মোটামুটি সব ছোট-বড় শিপিং কোম্পানির রিক্রুটিং অফিস আছে ভারত ও ফিলিপাইনে। এরপরেও ওদের দেশের ক্যাডেট আর জুনিয়র অফিসারদের একই দশা। বছরের পর বছর ধরে তারাও অপেক্ষা করেন জাহাজের জন্য।

ওই দুটি দেশের অনেক কোম্পানি ২০১৪ সালের পর ক্যাডেটসংখ্যা কমিয়েছে, এমনকি বন্ধও করে দিয়েছে ক্যাডেট রিক্রুটিং প্রোগ্রাম। আমাদের দেশে হচ্ছে তার উল্টো, ক্যাডেটের চাকরির সুযোগ না বাড়িয়ে আরও বেশি করে ক্যাডেট ভর্তি করা হচ্ছে।

সরকারি মেরিন একাডেমি একটি থাকতে আরও চারটি চালু করা হচ্ছে। আমার পরিচিত অনেকে বুয়েট, মেডিক্যাল ছাড়াও অনেক ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে মেরিনার হয়ে এখন আফসোস করেন। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে অন্য পেশা খুঁজছেন।

অনেকে ভাবতে পারেন, আমি মেরিন একাডেমিতে ভর্তির বিরুদ্ধে বলছি। এক্ষেত্রে বলব, আমি কাউকে মেরিনার হতে নিরুৎসাহিত করছি না। শুধু বলব, চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। ভালোমতো জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি, পুরুষ-নারী মিলিয়ে মোট ৮১৩ জন ক্যাডেট ভর্তির সার্কুলার দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এর যৌক্তিকতা নিয়ে আমার শঙ্কা রয়েছে।

বর্তমানে সব ক্যাডেট বা জুনিয়র অফিসার যে খারাপ অবস্থায় আছেন তা নয়। ১০ শতাংশ খুব ভালো আছেন, ২০-৩০ শতাংশ মোটামুটি অবস্থায় আর বাকিদের অবস্থা খুবই নাজুক।

আপনি যদি স্কলারশিপ বা ভালো কোম্পানিতে জায়গা করে নেয়ার সামর্থ্যের বিষয়ে কনফিডেন্ট থাকেন, তাহলে ভিন্ন কথা। তবে কল্পিত স্বপ্নে গা ভাসালে বিপদ মোটামুটি নিশ্চিত, সেটিও মাথায় রাখতে হবে।

লেখক: এক্স ক্যাডেট (৪৭তম ব্যাচ), বাংলাদেশ মেরিন অ্যাকাডেমি

এ বিভাগের আরো খবর