ঘাটতি না উদ্বৃত্ত বাজেট – এ বিতর্ক বহু পুরোনো। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বর্তমানে ঘাটতি বাজেট করা হয়। বাংলাদেশ শুরু থেকে এ নিয়ম অনুসরণ করে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করে আসছে।
তবে এবারের বাজেটে যে ঘাটতি ধরা হয়েছে, তা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মূলত, করোনাকালে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করতে ধার করে বেশি ব্যয়ের লক্ষ্য নিয়ে ঘোষণা করা হয় প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট।
তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক অর্থসচিব ড. আকবর আলি খান রচিত বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি বইয়ে বলা হয়েছে: ‘ইতিহাস বলে বেশির ভাগ সময়ই রাজাদের অর্থাভাব ছিল। আয় ও বেশি ব্যয়ের ফলে আর্থিক অনটনের সমস্যা দেখা যেত।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন ঘাটতি বাজেট করা হয়। বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি সহনীয় থাকলেও করোনার অভিঘাতে তা বেড়ে যায়। এ ছাড়া আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, যে কারণে বাজেট অর্থায়নে ধার বা ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অর্থনীতিতে ঘাটতির প্রভাব নিয়ে তর্ক আছে। যারা এর বিপক্ষে, তাদের মতে, বাজেট ঘাটতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বোঝা সৃষ্টি করে। কারণ, ঋণের প্রতিটি টাকা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শোধ করতে হবে।
তাদের মতে, অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে কর হার কমিয়ে বেসরকারি খাতকে সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়।
অপরদিকে যারা ঘাটতি বাজেটের পক্ষে তাদের মতে, ঘাটতি হলেই মূল্যস্ফীতি হবে না। বরং ব্যয় বেশি করলে উৎপাদন কর্মকাণ্ড বেগবান হবে। ফলে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান।
ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এই ঘাটতি শুধু দায় সৃষ্টি করে না। ঘাটতি দিয়ে যদি অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা হয়, তা হলে আয়ও সৃষ্টি করতে পারে।’
ঋণের সুদের পেছনে ব্যয়
বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধে। এটা এখন মোট বাজেটের ১৮ শতাংশের বেশি। প্রতি বছর বাজেটে এই বরাদ্দ বাড়ছেই। এবার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে সুদ পরিশোধে মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর ৯০ শতাংশ দিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করা হবে। বাকি ১০ শতাংশ বিদেশি ঋণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এটি এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা হবে।
যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে, তাতেও ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ। তবে অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, চূড়ান্ত হিসাব শেষে এই ঘাটতি কমবে।
কারণ, অর্থবছরের শুরুতে সরকার ব্যয়ের বিশাল যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, শেষ পর্যন্ত তা খরচ করতে পারবে না।
সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা
জিডিপির সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে বাংলাদেশে বাজেট প্রণয়নের রেওয়াজ আছে। এতদিন তা মেনেই বাজেট ঘোষণা করে আসছিল সরকার।
কিন্তু করোনাকালে এই নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে ঘাটতি ৬ শতাংশের বেশি ধরে দুটি বাজেট দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে: বেশি বেশি খরচ করে মন্দায় অচল অর্থনীতিকে চাঙা করা।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত পাঁচ অর্থবছরে ঘাটতি মেটাতে ঋণের সুদ পরিশোধে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা দিয়ে ৯টি পদ্মা সেতু বানানো যেত। পাঁচ বছরে এ খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ বিদ্যমান বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে বেশি।
পাঁচ বছরে ঘাটতির চিত্র
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয় ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি কোটি টাকা।
এতে মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা এবং ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ৫৮ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর মূল বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৫ শতাংশ।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের শেষ সময়ে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
ওই বাজেটে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ৪৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। আর ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
ওই বাজেটকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট বলে দাবি করেছিলেন মুহিত।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। মূল বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা এবং ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, মূল বাজেট ঘোষণার পর সংশোধন করা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সংশোধিত বাজেটও ঠিকমতো খরচ হয় না। ফলে প্রকৃত খরচেরে পর ঘাটতি কমে আসে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে দুর্বলতার কারণেই বাজেট ঘাটতি পূরণে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। এতে উদ্ধিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
কারণ, করোনাকালে সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, ভোগ ব্যয় বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা করা। এ জন্য ঋণের টাকা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষাসহ অবকাঠামো খাতে ব্যয় করার পরামর্শ দেন তারা।
সাবেক অর্থউপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ঘাটতি বেশি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না আমি। এখন আমাদের বেশি বেশি খরচ করতে হবে ধার করে। তবে এই টাকা ব্যয় করতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অবকাঠামো খাতে। এর ফলে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
বিদেশি ঋণ সস্তা
বিদেশি ঋণের সুদ হার নমনীয় হওয়ায় এটি বেশি করে সংগ্রহের পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। যে পরিমাণ ঋণ জমেছে, তার বিপরীতে বছরে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলার সুদ পরিশোধ করতে হয় সরকারকে।
তবে এ কথাও সত্যি, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে ঋণের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের সুদের হার অনেক বেশি, গড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণের জন্য মাত্র ১ থেকে দেড় শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। অর্থাৎ দেশীয় ঋণের খরচ অনেক বেশি। এ কারণেই দেশি ঋণে সুদ অনেক বেড়ে যায়।’
সক্ষমতা বেড়েছে
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলেন, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ক্রেডিট রেটিংও ভালো।
বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অনেক ভালো। ঋণ-অনুপাত জিডিপির ৪০ শতাংশের নিচে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের চেয়ে আমরা ভালো অবস্থানে আছি।
ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি ঋণ একদিকে বাড়ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও কয়েক গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ কখনও খেলাপি হয় নি। ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দিতে আগ্রহী।