প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এর বড় একটি অংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে। এর পরিমাণ ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ। বাকি রাজস্ব আসবে আয়কর ও আমদানি শুল্ক থেকে।
কিন্তু ভ্যাটের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় প্রস্তাবিত বাজেটে, টাকা কোন খাত থেকে আসবে, কীভাবে আসবে, বাজেটে তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করা গেলে এবং করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মাঠপর্যায়ে একাধিক ভ্যাট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন বাজেটে ভ্যাট আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা অর্জন নির্ভর করছে প্রধানত চারটি বিষয়ের ওপর।
এগুলো হলো সিগারেট, ওষুধ, মোবাইল ফোন ও ভ্যাট ফাঁকি রোধে প্রবর্তিত আধুনিক প্রযুক্তির মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি।
এরই মধ্যে ইএফডি চালু হয়েছে। আরও বড় পরিসরে এটি ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি মন্দা থাকায় বিভিন্ন খাতে ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তবে সিগারেট, ওষুধ ও মোবাইল ফোন খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙা হবে। ফলে উল্লেখিত তিনটিসহ অন্যান্য খাতে আদায় বাড়বে। এ ছাড়া ইএফডি মেশিন বসানোর আওতা বাড়ানো হলে আগামী বছরে ভ্যাট অনেক বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছর শেষ হবে ৩০ জুন। কিন্তু এনবিআর এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্বের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
তাতে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ভ্যাট, আয়কর, আমদানি শুল্কসহ মোট আহরণ হয় প্রায় ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকেও অনেক দূরে।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি অর্থবছর শেষে সর্বসাকল্যে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ হতে পারে।
তাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ঘাটতি থাকবে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরে ‘বাড়তি’ রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা না দেয়া হলেও যেটা দেয়া হয়েছে, সেটি অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করেন রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদউদ্দিন বলেন, ‘আইনের দুর্বলতা ও নিবিড় তদারকির অভাবে ভ্যাটের বড় একটি অংশই আদয় হয় না। আদায় বাড়াতে হলে ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ভ্যাট বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন যেতে হবে।’
এবারের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি ও ছাড় দেয়ার ফলে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
অপরদিকে সিগারেট ও তামাক পণ্যসহ কিছু খাতে ভ্যাট বাড়ানো হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে, আগামী বছর ‘বাড়তি’ সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আহরণ করতে হবে, যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়।
চলতি বাজেটে ভ্যাটের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আহরণ হয় ৭৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেটে দামি সিগারেটের ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে এ খাত থেকে ‘বাড়তি’ ৪ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আহরণ হবে বলে ভ্যাট কর্মককর্তারা আশা করছেন। তামাকজাত পণ্য থেকে আসবে ২০০ থেকে আড়াই শ কোটি টাকা।
করোনাকালে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ওষুধের ব্যবহার বাড়ায় এসব খাতে বাড়তি ৩ হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে।
এ ছাড়া, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য সেবা খাত থেকে আদায় বাড়বে বলে জানান এনবিআরের কর্মকর্তারা।
পণ্য ও সেবা– এই দুটি খাত থেকে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। এখন পর্যন্ত ৬৮ সেবার খাতে ভ্যাট আহরণ হয়। তবে অধিকাংশ সেবা খাত থেকেই ভ্যাট আদায় হয় না।
এনবিআরের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেবা খাতের আদায়যোগ্য ভ্যাটের ৭০ শতাংশই ফাঁকি হয়।
এই ফাঁকি বন্ধে পুরো ভ্যাট বিভাগে অটোমেশন এবং সেবার ২৫টি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে সরকার।
আরও ১০ হাজার ইএফডি
ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে গত বছরের আগস্ট থেকে ইএফডি চালু করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা, ও চট্টগ্রাম শহরে শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিপণীবিতান, মিষ্টির দোকানসহ বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৬টি ইএফডি বসানো হয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্ততায় বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইএফডি কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। আগামী ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আরও ১০ হাজার ইএফডি মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
‘এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে সারা দেশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এই মেশিন বসানো হবে। অনলাইনে ভ্যাট পুরোপুরি বাস্তবায়ন এবং ইএফডি মেশিন স্থাপন সম্পন্ন হলে ভ্যাট খাতে রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে বলে আমি আশা করছি।’
৫৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট অনলাইনের আওতায়
এখন সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে হয়। ২০১৯ সালে ভ্যাট অনলাইন চালু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ম চালু করা হয়।
বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে, যাকে বলা হয় বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বার বা বিআইএন।
এর মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৪৮টি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছে। অর্থ্যাৎ মোট নিবন্ধনের ৫৯ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমা দিচ্ছে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনের আওতায় আনতে পারলে ভ্যাট আদায় বর্তমানের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ বাড়বে।