বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সঞ্চয়পত্রের হিসাব মিলছে না কেন?

  •    
  • ৬ জুন, ২০২১ ১৩:৪৬

সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া সরকারের ঋণের হিসাব অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় যা দিয়েছেন, তাতে খটকা বেঁধেছে। ৯ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ, বছরজুড়ে নেয়া ঋণের পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় কীভাবে, তা অর্থনীতিবিদদের মাথায়ও ঢুকছে না।  

আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৩ হাজার ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। অথচ সংশোধিত বাজেটে হিসাবে দেখানো হয়েছে, আরও তিন মাস (এপ্রিল-জুন) গেলে অর্থাৎ বছরের পুরোটা শেষ হলে (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ হবে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে সম্ভব এটি? তাহলে কি ১ এপ্রিল থেকে ৩ জুন পর্যন্ত কোনো সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। ৬ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো সঞ্চয়পত্র কিনবে না মানুষ?

সংসদে বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী হিসাব দিচ্ছেন, বছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০ হাজার ৩০২ টাকা।

কিন্তু নয় মাসেই যে ৩৩ হাজার ২০ কোটি টাকা নেয়া হয়ে গেছে। ঋণ উল্টো ২ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা কমবে কীভাবে? সঞ্চয়পত্রের ঋণ ব্যাংকঋণের মতো নয়, যা অন্য কোনো খাত থেকে নিয়ে শোধ বা সমন্বয় করা হয়।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয়পত্রের মতো ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া সরকারের ঋণের ক্ষেত্রেও হিসাব-নিকাশ মেলে না।

অর্থমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছেন তার সংক্ষিপ্তসারে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন বলে লক্ষ্য ধরেছেন। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিলেন তিনি। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

অর্থবছরের শুরু থেকে গত ২০ মে পর্যন্ত (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ২০ মে) ব্যাংক থেকে সরকার মাত্র ৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

তাহলে কি অর্থবছরের বাকি এক মাস ১০ দিনে (২১ মে থেকে ৩০ জুন) ৭৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার? তা নিতে হলে প্রতিদিন ঋণ নিতে হবে ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা।

বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক আহসান এইচ মনসুরের মন্তব্য জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, “আমার কাছেও হিসাবটি কেমন জানি ‘গোজামিল’ লাগছে। কীভাবে সম্ভব কিছুই বুঝতে পারছি না। মুনাফা বেশির কারণে গোটা অর্থবছরজুড়েই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উল্লম্ফন দেখা গেছে।

‘সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রির কারণে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ারও প্রয়োজন হয়নি। নয় মাসে যে ঋণ নেয়া হয়ে গেছে, সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য তার থেকেও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা কম ধরা হয়েছে।’

‘এইটা কিসের হিসাব, কিসের অঙ্ক, কীভাবে সম্ভব কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না’, বলেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত) ৮৫ হাজার ৯৯০ কোটি ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৫২ হাজার ৯৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই ৯ মাসে এত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। ৯ মাসের বিক্রির এই অঙ্ক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুন-জুলাই) চেয়েও ২৭ শতাংশ বেশি।

শুধু তা-ই নয়, একক মাস হিসাবেও সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে গত মার্চ মাসে। এই মাসে ১০ হাজার ৭৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর আগে কখনো এক মাসে এত বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেননি ক্রেতারা।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। লোকে এটিকে ‘সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ’ হিসেবে বিবেচনা করে। এতে বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা।

‘এ অবস্থায় অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি বা হবে না, এমনটা ভাবা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়,’ বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনসুর।

ব্যাংক ঋণের হিসাব গোলমেলে

অর্থবছরজুড়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যত ঋণ নিয়েছে, শোধ করেছে (আগে নেয়া ঋণ) তার থেকে বেশি। সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয়নি।

কিন্তু বছরের শেষ দিকে এসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। প্রতিবারই অবশ্য বছরের শেষ দিকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ করে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার তুলনায় পরিশোধ বেশি ছিল।

তবে এখন ঋণ নেয়া বাড়ছে। আর সে জন্য ২০ মে পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।

আর তাতে ব্যাংক থেকে সরকারের মোট ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকায়।

এর আগে গত এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আগের ঋণ ১৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা কমে ১ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৬ কোটি টাকায় নেমেছিল।

বছরের শেষ সময়ে সরকারের বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে। এ কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি ঋণ নেয়ার পরও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। অবশ্য বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনেক কম।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে রেকর্ড ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ স্থিতির মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।

করোনাভাইরাস মহামারিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে নির্ভর করতে হবে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর।

এর মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেয়ার কঠিন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ।

ঘাটতির এই পরিমাণ আগের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আর সে জন্য নতুন বাজেটে বিদেশি ঋণের নির্ভরতা অনেকটাই বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

এবার বিদেশ থেকে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা আসবে বলে স্বপ্ন বুনেছেন তিনি। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন কামাল।

অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর