প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, এই বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান রক্ষা করবে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের ব্যয় বাড়াতেই হবে। কারণ, ব্যয় বাড়ালেই আয় বাড়বে। এ জন্য এবারের বাজেট সম্প্রসারণমূলক করা হয়েছে।’
শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। করোনার কারণে এবারও তিনি ভার্চুয়াল সংবাদ সংম্মেলন করেন। নতুন বাজেটে যেসব বিষয়ে সমালোচনা উঠে এসেছে, তার জবাব দেন অর্থমন্ত্রী।
শুরুতে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। এরপর সাংবদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বিশাল বাজেটে ঘোষণা করেন। এর এক দিন পর যথারীতি নতুন বাজেট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন অংশ নেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি খাত হচ্ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি। এ জন্য বেসরকারি খাতকে চালকের আসনে বসাতে হবে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আগে আমরা মুদ্রানীতিকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বাজেটে উল্লেখযোগ্যভাবে কর ছাড় দেয়া হয়নি।
‘এবারের বাজেটে ব্যাপক কর ছাড় দেয়া হয়েছে। কোনো রেট বাড়ানো হয়নি। কর ছাড় দেয়া হয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে কিছুই হবে না। সে জন্য বেসরকারি খাতকে সুযোগ-সুবিধা বেশি দেয়া হয়েছে। কারণ, তারাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।’
সবাইকে টিকা দিতে কত দিন
বাজেটে বলা হয়েছে, প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া হবে। হিসাব করে দেখা গেছে, দেশের সব মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনতে গেলে কমপক্ষে ৪ বছর সময় লাগবে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটি শুধু প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদি প্রয়োজন হয় তা হলে আরও বেশি পরিমাণে টিকা দেয়া হবে।
‘প্রথমে আমরা একটি উৎস থেকে টিকা আনার চেষ্টা করেছিলাম। তাতে সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। এখন আমরা বিকল্প উৎস থেকে চেষ্টা করছি। শিগগিরই টিকা আসবে।
‘কিন্তু যখন প্রথম টিকা দেশে এসেছিল, তখন মাইকিং করেও টিকা দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আগ্রহ বেড়েছে। তবে মোদ্দা কথা, সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে। টিকা কেনায় কোনো সংকট হবে না বলে আশা করছি।’
জিডিপি ও বাজেট ঘাটতি
নতুন বাজেটে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এটি অর্জিত হবে কি না, জানতে চাওয়া হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই হবে। এটি অর্জনে যা কিছু করা দরকার, তা আমরা পরিকল্পনা করেছি এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু হবে।’
ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ প্রায় সব দেশই ঘাটতি বাজেট করে। সে জন্য বেশি খরচের লক্ষ্যে সম্প্রসারণমূলক বাজেট করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬.২ শতাংশ। আর ভারতে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির ৬.৮ শতাংশ।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জিডিপির তুলনায় ঋণ অনুপাত এখনও সহনীয়। ৪০ শতাংশের নিচে। আমরা চীন ও ভারতের চেয়ে এ ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছি।’
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ এখন ৪৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। ফলে অন্য দেশকে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন ঋণ নিচ্ছি। কিন্তু একদিন আমি বলেছিলাম, ঋণ দেব। তা-ই সত্যি হয়েছে। এখন আমরা ঋণ দিতে পারি।’
বাজেটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই বাজেটটি ব্যবসাবান্ধব। যেসব কর প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, তা কাজে লাগালে বাড়বে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান।
‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা দেয়া। এখানে স্থানীয় শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য করহার (রেট) বাড়ানো নয়, কমানো। কারণ, করহার কমালে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’
হিমায়িত মাংস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় বাজেটে শুল্ক আরোপ করে কোনো লাভ হবে কি না, প্রশ্ন করা হলে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘দেশীয় ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় আমদানি করা মাংসে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কেন মাংস আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলো, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তটি ভালো। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতি হচ্ছে, বিদেশ থেকে যাতে কোনো পণ্য আমদানি না করতে হয়।’
এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী আমরা নীতি-সহায়তা প্রণয়ন করছি।’
করোনায় যারা চাকরি হারিয়েছে, তাদের জন্য বাজেটে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে অর্থসচিব বলেন, ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় করা হয়েছে। করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ সৃষ্টি করা। আশা করছি, এসব পদক্ষেপের ফলে যারা চাকরি হারিয়েছেন, আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে চাকরি ফিরে পাবেন তারা, যদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।’
এবারের বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৬.২ শতাংশ, এটা খুব বেশি কেন- জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ঘাটতি বেশি না। আমাদের ঋণ নেয়ার আরও বেশি সুযোগ রয়েছে। আমাদের ব্যয় বাড়াতেই হবে। ব্যয় বাড়াতে না পারলে আয় আসবে না।
‘রাজস্ব বেড়েছে। রপ্তানি বেড়েছে। রেমিটেন্সের অবস্থানও শক্তিশালী। সুতরাং আমি কোনো সমস্যা দেখি না (আই ডোন্ট সি অ্যানি প্রবলেম)।’
পরে ঘাটতি প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘বাজেটে ঘাটতি নতুন নয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাজেটে ঘাটতি থাকবেই। তবে এর পরিমাণ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, যেহেতু আমরা গত ১০ বছর ধরে প্রবৃদ্ধিসহ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছি, তাই আমাদের কোনো ভয় নেই। আমাদের ধারের বাজার খুব ভালো। আবার ধার পরিশোধের রেকর্ডও খুব ভালো। কারণ, আমরা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কখনোই খেলাপি হইনি।’
প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে বক্তৃতায় কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি, এটা কি ভুলে গেলেন, নাকি ইচ্ছাকৃত- এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেট বক্তব্য সব মিলিয়ে ছিল ৭৫ মিনিট। সব খাতের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। এর অর্থ এই নয় যে, খাতগুলো বরাদ্দ থেকে বাদ পড়েছে।’
এ প্রসঙ্গে অর্থসচিব বলেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষা খাতের ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে সব ব্যয়ই ওই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে খরচ করা হয়। এবার বাজেটেও প্রতিরক্ষা খাতে ৮ শতাংশ বরাদ্দ বেড়েছে।’
কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য
সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি খাতে অবকাঠামোগত যে সমস্যা ছিল, তা বিনিয়োগের মাধ্যমে দূর হচ্ছে। তবে করোনা মহামারি বড় বাধা। এরপরও এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। আমরা এখন কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের দিকে বেশি নজর দিচ্ছি, যাতে মানুষের আয় বাড়ে। এবার বাজেটেও কৃষি খাতের বরাদ্দ কম নয়। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে, যখনই টাকা দরকার হবে, প্রয়োজনে অন্যান্য খাত থেকে টাকা এনে চাহিদা মেটানো হবে।’