প্রস্তাবিত বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ না দেয়া হলেও কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ থাকার বিষয়টি বৈষম্য হিসেবে দেখছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
তারা বলছে, এই সুযোগ ন্যায্য করদাতাদের সঙ্গে বৈষম্য, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
শুক্রবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, নতুন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু না থাকলেও বিশেষভাবে ভবন নির্মাণ, বন্ড, রপ্তানি এলাকা, হাইটেক পার্কে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিশেষ এসআরও মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। এটা বন্ধ করা উচিত।
তবে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদা। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে কীভাবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বাড়বে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট কিছু নেই বাজেটে।’
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। ১০ শতাংশ কর দিয়ে নগদ টাকা ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা পুঁজিবাজার ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সাদা করা যাবে না। এ ছাড়া প্ল্যাটের আয়তনভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়েও কালোটাকা সাদা করা যাবে না।
বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে দেয়া এই সুযোগ আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সুযোগটি আর মিলছে না।
কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ ধারা অনুযায়ী, এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগটি রয়ে গেছে। সুযোগটি কতোদিন থাকবে, তা অবশ্য আয়কর অধ্যাদেশে বলা হয়নি। তবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শর্ত দিয়েছে, অপরাধ কার্যক্রমের মাধ্যমে এবং অবৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থ সাদা করা যাবে না। এ ছাড়া শিল্প খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও থাকছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অপ্রদর্শিত বৈধ আয় নির্ধারিত করের পাশপাশি ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে ঘোষণার সুযোগ তো আছেই।
গত এক বছর নগদ টাকা বেশি সাদা হয়েছে। নগদ টাকা সাদা করায় বেশি আগ্রহ করদাতাদের। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলঅই-মার্চ) সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৩৪ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করেছেন, যা, পরিমাণে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা তেমন একটা নেননি করদাতারা। এই নয় মাসে মাত্র ৩৪১ জন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এই সুযোগ নিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটের পর্যালোচনায় তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণা সিডিপি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
করমুক্ত আয়সীমা
গত অর্থবছরের মতোই এবারের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা রাখার বিষয়টি বোধগম্য হচ্ছে না সিডিপির।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম যাদের আয় বেশি তারা বেশি হারে কর দেবে। আর যাদের আয় কম তারা কম কর দেবে। কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন হয়নি।
যাদের আয় কম তারা কম হারে কর দিলে তাদের ব্যয়ের বা সঞ্চয় করার সুযোগ বাড়ত। ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য কর সীমা বাড়ানো হয়েছে, এটি ভালো উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি।
ফাহমিদা বলেন, ‘বাজেটে আগামীতে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে সে বিষয়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সে অনুযায়ী বরাদ্দ রাখা হয়নি। আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি স্পষ্টভাবে একটি মধ্যমেয়াদী নীতিমালা তৈরির। সেটি করা হলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।’
ব্যবসায়ীদের করছাড় দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে সিপিডি। তবে এ সুযোগের অপব্যবহার হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
ফাহমিদা বলেন, ‘রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার। ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফলে সাময়িক কর আদায় কমে যাবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে৷ তবে এ সুযোগের অপব্যবহার করা যাবে না।’
সামাজিক নিরাপত্তায় আরও বরাদ্দ দরকার ছিল
কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা খরচের যে পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাজিয়েছেন, তার মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি বরাদ্দ রেখেছেন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে।
এই অঙ্ক মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে আরও প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ লাখ গরিব মানুষ সরকারের সহায়তা পাবে। এত দিন এই ভাতা পাচ্ছিলেন ৮৮ লাখ গরিব, অসহায় মানুষ। নতুন করে সুবিধাভোগীর সংখ্যা যোগ হলে ভাতা পাওয়া গরিবের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এই বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত ছিল বলে মন্তব্য সিপিডির।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত ছিল। করোনায় নতুন অনেক দারিদ্র্য হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে স্বচ্ছ তালিকা দরকার। শহরে ও গ্রামের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কারা সুবিধা পাবে সে বিষয়ে আলাদা তালিকা করতে হবে।’
স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন ফেরানোর উদ্যোগ নেই
সিপিডির বলছে, স্বাস্থ্য খাতে কিছু বরাদ্দ বাড়লেও বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছে সিপিডি।
ফাহমিদা বলেন, ‘কিছু বরাদ্দ বাড়ালে হবে না। ব্যাপক সংস্কার করতে হবে এই খাতে। অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। কোভিড-১৯ চলে গেলেও আমাদের স্বাস্থ্যখাত যেন একটি শক্ত ভিত্তির ওপর থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এখনই।’
সিপিডি বলছে, সারা দেশে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে যন্ত্রপাতিসহ সেবা বাড়ালে চলমান পরিস্থিতিতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নির্ভরতা থাকতো না। এজন্য স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানো দরকার ছিল।
জীবন-জীবিকা নিয়ে ‘স্পষ্ট কিছু নেই’
এবারের বাজেটকে জীবন-জীবিকার বাজেট বলা হলেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু নেই বলে বলছে সিপিডি।
এ ব্যাপারে সিডিপির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনার এই সময়ে কোভিড নিয়ে সরকারের চিন্তার স্বচ্ছতা আছে। কিন্তু বরাদ্দের মিল নেই। সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামোর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। জীবন- জীবিকার বাজেট বলা হলেও এ বিষয় নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই।’
সিডিপি বলছে, বড় প্রকল্পে এত বরাদ্দ না হলেও চলত। এর ফলে সরকারের অন্য খাতের ব্যয় কাটছাট করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতে অনেক কর ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এত ছাড় সুবিধার পরেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
‘সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে সরকারের আর একটু সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। করমুক্ত আয়সীমা বাড়াতে হবে’-বলেন মোস্তাফিজুর।