পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এবারের বাজেটে করোনার ব্যাপারে ফোকাস আছে, কিন্তু সেটা দৃশ্যমান না।
তিনি বলেন, বলা হয়েছে হাসপাতালসহ বিভিন্ন খাতে টাকা দেয়া হবে, টিকাদানের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, ইত্যাদি। এ টাকা কিভাবে খরচ করা হবে, তার পরিকল্পনা নেই।
তিনি বলেন, ‘বড় প্রশ্ন হচ্ছে কবে নাগাদ বাংলাদেশের সবাইকে টিকা দেয়া হবে? তার জবাব কি বাজেটে আছে? কবে নাগাদ বাংলাদেশ করোনা মুক্ত হবে? এ জন্য কতজনকে টিকা দিতে হবে? তার কোনো আলপ বা উত্তর আছে নেই।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পর নিউজবাংলাকে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ধরে নিলাম ১২ কোটি মানুষকে করোনার টিকা দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী প্রাউডলি বলেছেন, মাসে ২৫ লাখ ডোজ টিকা দেয়া হচ্ছে। এটা ভালো কথা। কিন্তু ১২ কোটি মানুষের জন্য ২৪ কোটি ডোজ টিকা দিতে হবে। দিনে এক লাখ বা মাসে ত্রিশ লাখ করে হলেও তো ১২ কোটি মানুষকে ২৪ কোটি ডোজ দিতে হলে সাত ৭ বছর লাগবে। এটা কি গ্রহণযোগ্য? তত দিন কি দেশ পিছিয়ে থাকবে?’
তিনি বলেন, ‘এ সময় কি আমাদের ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে? বিনিয়োগ হবে? আমাদের ভবিষ্যত আছে? নেই।
‘আমরা চেয়েছিলাম আগামী অর্থবছরের মধ্যে দেশ করোনামুক্ত হবে, এমন একটা পরিকল্পনা বাজেটে থাকুক। কিন্তু নেই। আমার ধারণা, সেই পরিকল্পনা সরকারের কাছেও নেই। তবে জরুরি ভিত্তিতে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা খুবই দরকার। এটি যেই-সেই পরিকল্পনা হলে হবে না।
‘আমরা চার মাসের আগে ভ্যাকসিন পাচ্ছি না। কিন্তু এক বছরের মধ্যে করোনামুক্ত হতে হলে টিকা পাওয়ার পর থেকে দিনে ১৮ থেকে ২০ লাখ ডোজ টিকা দিতে হবে। তাই যখন পাব, তখন যেন দ্রুত মবিলাইজ হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুতি দিতে হবে। যেন ছয় মাসের মধ্যেই দেশকে করোনামুক্ত করতে পারি সে উদ্যোগ নিতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কিন্তু দিনে ১৫ লাখ ভ্যাকসিন দেয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। কোনোদিন হবেও না। তারা কোনো শিক্ষা নেয় না। তারা তো গত এক বছরেও শেখেনি। তাই এ জন্য সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, স্থানীয় পর্যায়ের এমপি থেকে শুরু করে উপজেলা-ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বার থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে ন্যাশনাল মোবিলাইজ টিম করতে হবে। প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে গিয়ে সবাইকে টিকা দিতে হবে। এ জন্য বিশাল টিম লাগবে, বিশাল বাজেট লাগবে, বিশাল মজিলাইজেশন লাগবে। কয়েক লাখ ভলান্টিয়ার নিতে হবে। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পারবে না। তাদের সংখ্যা আর কত হাজার!’
তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটে সামাজিক নিরপত্তা কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ বেড়েছে। এটা বাড়বে ভালো কথা। এ টাকা যাবে গরিবদের জন্য, অসহায়দের জন্য, বয়স্কদের জন্য, বৃদ্ধদের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। কিন্তু যারা এর মধ্যে পড়ছে না, করোনার কারণে যারা নতুন করে সাময়িকভাবে দরিদ্র হয়েছেন, তাদের জন্য কিছুই দেখলাম না। এটা দুঃখজনক। তারা সবাই কর্মক্ষম। কিন্তু করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের জন্য আগামী এক বছর ১ কোটি পরিবারকে মাসে ২ হাজার টাকা করে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছিলাম আমরা। এতে ২৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হতো। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ দেখলাম না।
‘মধ্যবিত্তদের জন্য এবার তেমন কিছু নেই। করপোরেট কর হার কমার কারণে উচ্চবিত্তরা সুফল পাবে। অন্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করপোরেট কর হার কমানোর দরকারও আছে।
‘করমুক্ত আয়সীমা একই রাখা ঠিক আছে। কারণ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালে কর দেয়ার যোগ্য একটা শ্রেণি কখনই করের আওতায় আসবে না। এ স্তরের করের পরিমাণও খুব বেশি না। পৃথিবীর সব দেশেই করমুক্ত আয়সীমা অনেক কম।
‘কালো টাকার ব্যাপারে অর্থ বিলে কী আছে, বলা যাচ্ছে না। তবে যেটুকু বুঝলাম, নতুন করে কোনো খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের আর সুযোগ থাকছে না। এটা ভালো। অন্তত সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হলো। তবে পৃথিবীর অনেক দেশেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো না। তাদের টাকার উৎস সম্পর্কে বলতে হয়। যত বছর আগের টাকা তার প্রতি বছরের জন্য জরিমানা দিতে হয়। বরং জরিমানার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। যত সময় যাবে জরিমানাও তত বাড়বে। তাই আমাদের যেটা করা হয়েছে, কোনো প্রশ্ন করা হবে না – সেটা ভুল।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অন্য বিষয়গুলো দেখলে বাজেট গতবারের চেয়ে কিছুটা বাস্তবসম্মত। বাজেটের আকার, রেভিনিউ আয়, ব্যয় দুটোই বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয়েছে। যদিও রেভিনিউ আদায় হবে বলে মনে হয় না। তবে কাছাকাছি যাবে। অর্টিফিশিয়াল ইমপোজ মনে হয়নি।’